পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট Wり(?○ আদায় করিয়া লওয়া ভালো । মাতঙ্গিনীকে মঙ্গলার নিকট হইতে গোপনে ঔষধ আনাইতে পাঠাইলেন । মঙ্গলা নানাবিধ শিকড় লইয়া সমস্ত রাত ধরিয়া কাটিয়া ভিজাইয়া বাটিয়া মিশাইয়া মন্ত্র পড়িয়া বিষ প্ৰস্তুত করিতে লাগিল । সেই নিস্তব্ধ গভীর রাত্রে নির্জন নগরপ্রান্তে প্রচ্ছন্ন কুটির-মধ্যে হামানদিস্তার শব্দ উঠিতে লাগিল, সেই শব্দই'তাহার একমাত্র সঙ্গী হইল, সেই অবিশ্রাম একঘেয়ে শব্দ তাহার নর্তনশীল উৎসাহের তালে তালে করতালি দিতে লাগিল, তাহ, উৎসাহ দ্বিগুণ নাচিতে লাগিল, তাহার চােখে আর ঘুম রহিল ঔষধ প্ৰস্তুত করিতে পাচদিন লাগিল । বিষ প্ৰস্তুত করিতে পাচদিন লাগিব।ার আবশ্যক করে না । কিন্তু সুরমা মরিবার সময় যাহাতে যুবরাজের মনে দয়া না হয়, এই উদ্দেশে মন্ত্র পড়িতে ও অনুষ্ঠান করিতে অনেক সময় লাগিল । প্রতাপাদিত্যের মত লইয়া মহিষী সুরমাকে আরো কিছুদিন রাজবাটীতে থাকিতে দিলেন । সুরমা চলিয়া যাইবে, বিভা চারি দিকে অকূল পাথার দেখিতেছে । এ কয়দিন সে অনবরত সুরমার কাছে বসিয়া আছে । একটি মলিন ছায়ার মতো সে চুপ করিয়া সুরমার সঙ্গে সঙ্গে ফেরে। এক-একটা দিন যায়, সন্ধা আইসে, বিভা ততই যেন ঘনিষ্ঠতর ভাবে সুরমাকে আলিঙ্গন করিয়া ধরিয়া রাখিতে চায় । দিনগুলিকে কে যেন তাহার প্রাণপণ আকর্ষণ হইতে টানিয়া ছিড়িয়া লইয়া যাইতেছে । বিভার চারি দিকে অন্ধকার । সুরমার চক্ষেও সমস্তই শান্য । তাহার আর উত্তর দক্ষিণ পূর্ব পশি । নাই, সংসারের দিগবিদিক সমস্ত মিশাইয়া গেছে । সে উদয়াদিত্যের পায়ের কাছে পড়িয়া থাকে, কোলের উপর শুইয়া থাকে, তাহার মুখের পানে চুপ করিয়া চাহিয়া থাকে, আর কিছু করে না । বিভাকে বলে, “বিভা, তোর কাছে আমার সমস্ত রাখিয়া গেলাম ।” বলিয়া দুই হাতে মুখ আচ্ছাদন করিয়া কাদিয়া ফেলে । অপরাহু হইয়া আসিয়াছে ; কাল প্ৰত্যুষে সুরমার বিদায়ের দিন । তাহার গার্হস্থ্যের যাহা-কিছু সমস্ত একে একে বিভার হাতে সমপণ করিল । উদয়াদিত্য প্রশান্ত ও দৃঢ়প্ৰতিজ্ঞ ভাবে বসিয়া আছেন । তিনি স্থির করিয়াছেন, হয় সুরমাকে রাজপুরীতে রাখিবেন নয় তিনিও চলিয়া যাইবেন । যখন সন্ধ্যা হইল তখন সুরমা আর দাড়াইতে পারিল না, তাহার পা কঁাপিতে লাগিল, মাথা ঘুরিতে লাগিল । সে শয়নগৃহে গিয়া শুইয়া পড়িল, কহিল, “বিভা, বিভা, শীঘ্র একবার তাহাকে ডাক, আর বিলম্ব নাই!” উদয়াদিত দ্বারের কাছে আসিতেই সুরমা বলিয়া উঠিল, “এসো, এসো, আমার প্রাণ কেমন করিতেছে “ বলিয়া দুই বাহু বাড়াইয়া দিল । উদয়াদিত্য কাছে আসিতেই তাহার পা দুটি জড়াইয়া ধরিল উদযাদিত্য বসিলেন, তখন সুরমা বহু কষ্টে নিশ্বাস লইতেছে ; তাহার হাত পা শীতল হইয়া আসিয়াছে উদয়াদিতা ভীত হইয়া ডাকিলেন, “সুরমা ।” সুরমা অতি ধীরে মাথা তুলিয়া উদয়াদিত্যের মুখের পানে চাহিয়া কহিল, “কী নাথ ।” উদয়াদিত ব্যাকুল হইয়া কহিলেন, “কী হইয়াছে সুরমা ?” সুরমা কহিল, “ বোধ করি আমার সময় হইয়া আসিয়াছে।” বলিয়া উদয়াদিত্যের কণ্ঠ আলিঙ্গন করিবার জন্য হাত উঠাইতে চাহিল, হাত উঠিল না । কেবল মুখের দিকে সে চাহিয়া রহিল । উদয়াদিত্য দুই হাতে সুরমার মুখ তুলিয়া ধরিয়া কহিলেন, “সুরমা, সুরমা তুমি কোথায় যাইবে সুরমা । আমার আর কে রহিল ?” সুরমার দুই চোখ দিয়া জল পড়িতে লাগিল । সে কেবল বিভার মুখের দিকে চাহিল। বিভা তখন হতচেতন হইয়া বোধশূন্য নয়নে সুরমার দিকে চাহিয়া আছে। যেখানে প্রতি সন্ধ্যায় সুরমা ও উদয়াদিত বসিয়া থাকিতেন, সম্মুখে সে বাতায়ন উন্মুক্ত । আকাশের তারা দেখা যাইতেছে, ধীরে ধীরে বাতাস বহিতেছে, চারি দিক স্তব্ধ। ঘরে প্রদীপ জ্বালাইয়া গেল । রাজবাটীতে পূজার শাখ-ঘণ্টা বাজিয়া ক্ৰমে থামিয়া গেল । সুরমা উদয়াদিত্যকে মৃদুস্বরে কহিল, “একটা কথা কও, আমি চোখে ভালো দেখিতে পাইতেছি না ।” k ক্রমে রাজবাটীতে রাষ্ট্র হইল যে, সুরমা নিজ হস্তে বিষ খাইয়া মরিতেছে। রাজমহিষী ছুটিয়া আসিলেন, সকলে ছুটিয়া আসিল । সুরমার মুখ দেখিয়া মহিষী কঁাদিয়া উঠিয়া কহিলেন, “সুরমা মা