পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ኃ(? 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী আমার. তুই এইখানেই থাক, তোকে কোথাও যাইতে হইবে না । তুই আমাদের ঘরের লক্ষ্মী, তোকে কে যাইতে বলে ?” সুরমা শাশুড়ির পায়ের ধূলা মাথায় তুলিয়া লইল । মহিষী দ্বিগুণ কঁাদিয়া উঠিয়া কহিলেন, “মাতুই কি রাগ করিয়া গেলি রে ?” তখন সুরমার কণ্ঠরোধ হইয়াছে কী কথা বলিতে গেল, বাহির হইল না !! রাত্রি যখন চারিদণ্ড আছে, তখন চিকিৎসক কহিলেন, “শেষ হইয়া গেছে।” “দাদা, কী হইল গো” বলিয়া বিভা সুরমার বুকের উপরে পড়িয়া সুরমাকে জড়াইয়া ধরিল । প্রভাত হইয়া গেল, উদয়াদিত্য সুরমার মাথা কোলে রাখিয়া বসিয়া রহিলেন । অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ সুরমা কি আর নাই ? বিভার কিছুতেই তাহা মনে হয় না কেন ? যেন সুরমার দেখা পাইবে, যেন সুরমা ঐ দিকে কোথায় আছে! বিভা ঘরে ঘরে ঘুরিয়া বেড়ায়, তাহার প্রাণ যেন সুরমাকে খুঁজিয়া বেড়াইতেছে। চুল র্বাধিবার সময় সে চুপ করিয়া বসিয়া থাকে, যেন এখনই সুরমা আসিবে, তাহার চুল র্বাধিয়া দিবে, তাহারই জন্য অপেক্ষা করিতেছে। না রে না, সন্ধ্যা হইয়া আসিল, রাত্রি হইয়া আসে, সুরমা বুঝি আর আসিল না। চুল বাধা আর হইল না। আজ বিভার মুখ এত মলিন হইয়া গিয়াছে, আজ বিভা এত কঁাদিতেছে, তবু কেন সুরমা আসিল না, সুরমা তো কখনো এমন করে না । বিভার মুখ একটু মলিন হইলেই অমনি সুরমা তাহার কাছে আসে, তাহার গলা ধরে, প্ৰাণ জুড়াইয়া তাহার মুখের পানে চাহিয়া থাকে । আর আজ— ওরে, আজ বুক ফাটিয়া গেলেও সে আসিবে না । উদয়াদিত্যের অর্ধেক বল অর্ধেক প্ৰাণ চলিয়া গিয়াছে । প্ৰত্যেক কাজে যে তাহার আশা ছিল, উৎসাহ ছিল, যাহার মন্ত্রণা তাহার একমাত্ৰ সহায় ছিল, যাহার হাসি র্তাহার একমাত্র পুরস্কার ছিল— সে-ই চলিয়া গেল । তিনি তাহার শয়নগৃহে যাইতেন, যেন কী ভাবিতেন, একবার চারি দিকে দেখিতেন, দেখিতেন— কেহ নাই। ধীরে ধীরে সেই বাতায়নে আসিয়া বসিতেন ; যেখানে সুরমা বসিত সেইখানটি শূন্য রাখিয়া দিতেন— আকাশে সেই জ্যোৎস্না, সম্মুখে সেই কানন, তেমনি করিয়া বাতাস বহিতেছে— মনে করিতেন, এমন সন্ধ্যায় সুরমা কি না আসিয়া থাকিতে পরিবে । সহসা তাহার মনে হইত, যেন সুরমার মতো কার গলার স্বর শুনিতে পাইলাম, চমকিয়া উঠিতেন, যদিও অসম্ভব মনে হইত, তবু একবার চারি দিক দেখিতেন, একবার বিছানায় যাইতেন, দেখিতেনকেহ আছে কি না। যে উদয়াদিত্য সমস্ত দিন শত শত ক্ষুদ্র কাজে ব্যস্ত থাকিতেন, দরিদ্র প্রজারা তাহাদের খেতের ও বাগানের ফলমূল শাকসবজি উপহার লইয়া তাহার কাছে আসিত, তিনি তাহাদের জিজ্ঞাসা-পড়া করিতেন, তাহাদের পরামর্শ দিতেন, আজকাল আর সে-সব কিছুই করিতে পারেন না, তবুও সন্ধ্যাবেলায় শ্রান্ত হইয়া পড়েন । শ্রান্তপদে শয়নালয়ে আসেন, মনের মধ্যে যেন একটা আশা থাকে যে, সহসা শয়নকক্ষের দ্বার খুলিলেই দেখিতে পাইব- সুরমা সেই বাতায়নে বসিয়া আছে। উদয়াদিত্য যখন দেখিতে পান, বিভা একাকী স্নানমুখে ঘুরিয়া বেড়াইতেছে, তখন তাহার প্রাণ কাদিয়া উঠে । বিভাকে কাছে ডাকেন, তাহাকে আদর করেন, তাহাকে কত কী মেহের কথা বলেন, অবশেষে দাদার হাত ধরিয়া বিভা বঁকাদিয়া উঠে, উদয়াদিত্যেরও চোখ দিয়া জল পড়িতে থাকে । একদিন উদয়াদিত্য বিভাকে ডাকিয়া কহিলেন, “বিভা, এ বাড়িতে আর তোর কে রহিল ? তোকে এখন শ্বশুরবাড়ি পাঠাইবার বন্দোবস্ত করিয়া দিই। কী বলিস ? আমার কাছে লজ্জা করিস না বিভা । তুই আর কার কাছে তোর মনের সাধ প্রকাশ করিবি বল ?” বিভা চুপ করিয়া রহিল। কিছু বলিল না। এ কথা কি আর জিজ্ঞাসা করিতে হয় ? পিতৃভবনে কি আর তাহার থাকিতে ইচ্ছা করে ? পৃথিবীতে যে তাহার একমাত্র জুড়াইবার স্থল আছে, সেইখানে— সেই চন্দ্ৰদ্বীপে যাইবার জন্য তাহার প্রাণ অস্থির হইবে না তো কী ? কিন্তু তাহাকে লাইতে এ পর্যন্ত একটিও তো লোক আসিল না ! কেন আসিল না ? বিভাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইবার প্রস্তাব উদয়াদিত্য একবার পিতার নিকট উত্থাপন করিলেন । প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “বিভাকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইতে আমার কোনো আপত্তি নাই। কিন্তু তাহাদের