পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

VG Vo রবীন্দ্র-রচনাবলী সাপের মতো চক্ৰ ধরিতে শিখিয়াছে । আমরা পুরুষানুক্রমে রাজসভায় ভাড়বৃত্তি করিয়া আসিতেছি, আমরা বেদে, আমরা জাতি-সােপ চিনি না ?” রাজা রামচন্দ্র রায় বিষম সস্তুষ্ট হইয়া সহাস্যবিদনে গুড়গুড়ি টানিতে লাগিলেন । আজকাল প্রত্যহ সভায় প্রতাপাদিত্যের উপর একবার কবিয়া আক্ৰমণ হয়। প্রতাপাদিত্যের পৃষ্ঠ লক্ষ্যপূর্বক শব্দভেদী বচনবাণ বর্ষণ করিয়া সেনানীদের তৃণ নিঃশর হইলে সভা ভঙ্গ হয় । যাহা হউক, আজিকার বিচারে অপরাধী অনেক কাদাকাটি করাতে দোর্দণ্ডপ্রতাপ রামচন্দ্র রায় কহিলেন, “আচ্ছা যা, এ যাত্রা বাচিয়া গেলি, ভবিষ্যতে সাবধান থাকিস ।” কথাই চলিতে লাগিল । রামাই কহিল, “আপনি তো চলিয়া আসিলেন, এদিকে যুবরাজ বাবাজি বিষম গোলে পড়িলেন । রাজার অভিপ্ৰায় ছিল, কন্যাটি বিধবা হইলে হাতের লোহা ও বালা দুগাছি বিক্রয় করিয়া রাজকোষে কিঞ্চিৎ অর্থাগম হয় । যুবরাজ তাহাতে ব্যাঘাত করিলেন । তাহা লইয়া তম্বি কত !” রাজা হাসিতে লাগিলেন, কহিলেন, “বটে !” মন্ত্রী কহিলেন, “মহারাজ, শুনিতে পাই, প্রতাপাদিত্য আজকাল আপসোসে সারা হইতেছেন । এখন কী উপায়ে মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইবেন, তাহাই ভাবিয়া তাহার আহারনিদ্রা নাই ।” । আনন্দ বোধ হইল । মন্ত্রী কহিল, “আমি বলিলাম, আর মেয়েকে শ্বশুরবাড়ি পাঠাইয়া কাজ নাই । তোমাদের ঘরে মহারাজ বিবাহ করিয়াছেন, ইহাতেই তোমাদের সাত পুরুষ উদ্ধার হইয়া গেছে। তাহার পরে আবার ভুকু মেয়েকে ঘরে আনন্স ফর কি করা, এত গুণ এখনাে তোমরা করা নাই । কেমন হে কর ।” রামাই কহিল, “তাহার সন্দেহ আছে ! মহারাজ, আপনি যে পাকে পা দিয়াছেন, সে তো পাকের বাবার ভাগ্য, কিন্তু তাই বলিয়া ঘরে ঢুকিবার সময় পা ধুইয়া আসিবেন না তো কী !” এইরূপে হাস্যপরিহাস চলিতে লাগিল। প্রতাপাদিত্য ও উদয়াদিত্যের কাল্পনিক মূর্তি সম্মুখে রাখিয়া তাহাদিগকে ক্ষতবিক্ষত করা হইতে লাগিল। উদয়াদিত্যের যে কী অপরাধ তাহা বুঝিতে পারি না। তিনি যে নিজে বিপদকে অগ্রাহ্য করিয়া রামচন্দ্র রায়ের প্রাণরক্ষা করিলেন, সে-সকল কথা চুলায় গেল, আর তিনি প্রতাপাদিত্যের সন্তান হইয়াছেন এই অপরাধে রামচন্দ্র রায় তাহার কথা তুলিয়া অকাতরে হাস্যপরিহাস করিতে লাগিলেন । রামচন্দ্র রায় যে নিষ্ঠুর তাহা নহে, তিনি একজন লঘুহৃদয় ংকীর্ণপ্ৰাণ লোক । উদয়াদিত্য যে তাহার প্রাণ রক্ষা করিয়াছেন, তজজন্য তিনি কৃতজ্ঞ নহেন । তিনি মনে করেন, ইহা তো হইবেই, ইহা না হওয়াই অন্যায় । রামচন্দ্র রায় বিপদে পড়িলে তাহাকে সকলে জগৎ-সংসারের প্রাণে বেদনা লাগে । তিনি মনে করিতে পারেন না যে, পৃথিবীর একজন অতি ক্ষুদ্রতম লোকেরও নিজের বিপদের কাছে মহারাজাধিরাজ রামচন্দ্র রায় কিছুই নহে। দিবারাত্ৰি শত শত স্তুতিবাদকের দাড়িপাল্লায় এক দিকে জগৎকে ও আর-এক দিকে নিজেকে চড়াইয়া তিনি নিজেকেই ওজনে ভারী বলিয়া স্থির করিয়া রাখিয়াছেন, এইজন্য সহজে আর কাহারও উপরে তঁর কৃতজ্ঞতার উদয় হয় না। তাহা ছাড়া উদয়াদিত্যের প্রতি কৃতজ্ঞতার উদয় না হইবার আর-এক কারণ এই যে, তিনি মনে করেন উদয়াদিত্য নিজের ভগিনীর জন্যই তাহাকে বঁাচাইয়াছেন, তাহার প্রাণরক্ষাই উদয়াদিত্যের উদ্দেশ্য ছিল না। তাহা ছাড়া যদি বা রামচন্দ্রের হৃদয়ে কৃতজ্ঞতার সঞ্চার হইত, তবুও তিনি উদয়াদিত্যকে লইয়া হাস্যপরিহাসের ক্ৰটি করিতেন না । কারণ যেখানে দশজনে মিলিয়া সেখানে তিনি তাহাদের মুখ বন্ধ করেন বা তাহাদের সহিত যোগ না দেন, এমন তাহার মনের জোর নাই তাহার মনে হয়, তাহা হইলে সকলে কী মনে করিবে ।