পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট VGłS না । বিভা তাই দেখিয়া নিশ্বাস ফেলিয়া শুইতে যায়, সে আর আহার স্পর্শ করে না । বিভা কথা কহিতে, গল্প করিতে চেষ্টা করে, কিন্তু বিভা অধিক কথা কহিতে পারে না । কী করিয়া যে সুখে রাখিবে ভাবিয়া পায় না। সে কেবল ভাবে, আহা যদি দাদামহাশয় থাকিতেন ! আজকাল উদয়াদিত্যের মনে কেমন একটা ভয় উপস্থিত হইয়াছে। তিনি প্রতাপাদিত্যকে অত্যন্ত ভয় করেন। আর সে পূর্বেকার সাহস নাই। বিপদকে তৃণজ্ঞান করিয়া অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রাণপণ করিতে এখন আর পারেন না । সকল কাজেই ইতস্তত করেন, সকল বিষয়েই সংশয় উপস্থিত হয় । একদিন উদয়াদিত্য শুনিলেন ছাপরার জমিদারের কাছারিতে রাত্ৰিযোগে লাঠিয়াল পাঠাইয়া কাছারি লুট করিবার ও কাছারিতে আগুন লাগাইয়া দিবার আদেশ হইয়াছে। উদয়াদিত্য তৎক্ষণাৎ তাহার অশ্ব প্রস্তুত করিতে কহিয়া অন্তঃপুরে গেলেন। শয়নগৃহে প্রবেশ করিয়া একবার চারি দিক দেখিলেন। কী ভাবিতে লাগিলেন । ভাবিতে ভাবিতে অন্যমনস্ক হইয়া বেশ পরিবর্তন করিতে লাগিলেন । বাহিরে আসিলেন । ভূত্য আসিয়া কহিল, “যুবরাজ, অশ্ব প্রস্তুত হইয়াছে। কোথায় যাইতে হইবে ?” যুবরাজ কিছুক্ষণ অন্যমনস্ক হইয়া ভূত্যের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন ও অবশেষে কহিলেন, “কোথাও না । তুমি অশ্ব লইয়া যাও।” একদিন এক ক্ৰন্দনের শব্দ শুনিতে পাইয়া উদয়াদিত্য বাহির হইয়া আসিলেন, দেখিলেন রাজকর্মচারী এক প্রজাকে গাছে বাধিয়া মারিতেছে। প্ৰজা কঁাদিয়া যুবরাজের মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “দোহাই যুবরাজ ।” যুবরাজ তাহার যন্ত্রণা দেখিতে পারিলেন না, তাড়াতাড়ি ছুটিয়া গৃহের মধ্যে প্রবেশ করিলেন । আগে হইলে ফলাফল বিচার না করিয়া কর্মচারীকে বাধা দিতেন, প্ৰজাকে রক্ষা করিতে চেষ্টা করিতেন । ভাগবত ও সীতারামের বৃত্তি বন্ধ হইয়া গেছে। তাহাদিগকে প্রকাশ্যে অথবা গোপনে অর্থ সাহায্য করিতে যুবরাজের আর সাহস হয় না। যখনই তাঁহাদের কষ্টের কথা শুনেন, তখনই মনে করেন, ‘আজই আমি টাকা পাঠাইয়া দিব ।” তাহার পরেই ইতস্তত করিতে থাকেন, পাঠানো আর হয় না । কেহ যেন না মনে করেন, উদয়াদিত্য প্ৰাণের ভয়ে এরূপ করিতেছেন । সম্প্রতি জীবনের প্রতি তাহার যে পূর্বাপেক্ষা বিশেষ আসক্তি জন্মিয়াছে তাহা নহে। তাহার মনে একটা অন্ধ ভয় উপস্থিত হইয়াছে। প্রতাপাদিত্যকে তিনি যেন রহস্যময় কী একটা মনে করেন । যেন উদয়াদিত্যের অদৃষ্ট, উদয়াদিত্যের ভবিষ্যৎ জীবনের প্রতিদিন প্রতি মুহূর্ত প্রতাপাদিত্যের মুষ্টির মধ্যে রহিয়াছে। উদয়াদিত্য যখন মৃত্যুকে আলিঙ্গন করিতে যাইতেছেন, জীবনের শেষ মুহুর্তে অবস্থান করিতেছেন, তখনো যদি প্রতাপাদিত্য ভুকুঞ্চিত করিয়া বীচিতে আদেশ করেন, তাহা হইলে যেন তখনাে তাহাকে মৃত্যুর মুখ হইতে ফিরিয়া আসিতে হইবে । একবিংশ পরিচ্ছেদ বিধবা রুক্মিণীর (মঙ্গলার) কিঞ্চিৎ নগদ টাকা আছে। সেই টাকা খাটাইয়া সুন্দ লইয়া সে জীবিকা নির্বাহ করে । রূপ এবং রুপা এই দুয়ের জোরে সে অনেককে বশে রাখিয়াছে। সীতারাম শৌখিন লোক, অথচ ঘরে এক পয়সার সংস্থান নাই, এইজন্য রুক্মিণীর রূপ ও রুপা উভয়ের প্রতিই তাহার আন্তরিক টান আছে। যেদিন ঘরে হাড়ি কঁদিতেছে, সেদিন সীতারামকে দেখো, দিব্য নিশ্চিন্ত মুখে হাঁতে লাঠি লইয়া পাতলা চাদর উড়াইয়া বুক ফুলাইয়া রাস্তা দিয়া চলিতেছে, মঙ্গলার বাড়ি যাইবে । পথে যদি কেহ জিজ্ঞাসা করে, “কেমন হে সীতারাম, সংসার কেমন চলিতেছে ?” সীতারাম তৎক্ষণাৎ অমানবদনে বলে, “বেশ চলিতেছে। কাল আমাদের ওখানে তোমার নিমন্ত্রণ রহিল ।” সীতারামের বড়ো বড়ো কথাগুলা কিছুমাত্র কমে নাই, বরঞ্চ অবস্থা যতই মন্দ হইতেছে কথার পরিমাণ লম্বা ও চওড়ার দিকে ততই বাড়িতেছে। সীতারামের অবস্থা বড়ো মন্দ হইতে চলিল। সম্প্রতি এমন হইয়া