পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট VVS তোমার কাছে আমি চিরকাল মুর্থ।” সীতারাম মনে মনে ভাবিল খুব জবাব দিয়াছি, বেশ কথা জোগাইয়াছে । আবার কহিল, “আচ্ছা ভাই, কথাটা যদি তােমার পছন্দ না হইল, কী বলিয়া ডাকিলে তুমি খুশি রুক্মিণী হাসিয়া কহিল, “বলো প্ৰাণ ৷” সীতারাম কহিল, “প্ৰাণ ।” রুক্মিণী কহিল, “বলো প্রিয়ে ।” রুক্সিণী কহিল, “বলো প্ৰিয়তমে ।” রুক্মিণী কহিল, “বলো প্ৰাণপ্রিয়ে ।” সীতারাম কহিল, “প্ৰাণপ্ৰিয়ে, আচ্ছা ভাই প্ৰাণপ্ৰিয়ে, তুমি যে টাকাটা দিলে, তাহার সুন্দ কত লাইবে ?” রুক্মিণী রাগ করিল, মুখ বাকাইয়া কহিল, “যাও যাও, এই বুঝি তোমার ভালোবাসা । সুদের কথা কোন মুখে জিজ্ঞাসা করিলে ?” সীতারাম আনন্দে উচ্ছসিত হইয়া কহিল, “না না, সে কি হয় ? আমি কি ভাই সত্য বলিতেছিলাম ? আমি যে ঠাট্টা করিতেছিলাম। এইটে আর বুঝিতে পারিলে না ? ছিঃ প্রিয়তমে।” সীতারামের মায়ের কী রোগ হইল জানি না, আজকাল প্ৰায় মাঝে মাঝে সে জামাইবাড়ি যাইতে লাগিল ও টাকা বাহির করিয়া দিবার বিষয়ে তাহার স্মরণশক্তি একেবারে বিলুপ্ত হইয়া গেল । কাজেই সীতারামকে প্ৰায় মাঝে মাঝে রুক্সিণীর কাছে আসিতে হইত। আজকাল দেখা যায় সীতারাম ও রুক্সিণীতে মিলিয়া অতি গোপনে কী একটা বিষয় লইয়া পরামর্শ চলিতেছে । অনেকদিন পরামর্শের পর সীতারাম কহিল, “আমার ভাই অত ফন্দি আসে না, এ বিষয়ে ভাগবতের সাহায্য না লইলে চলিবে না ।” পড়িতেছে । বাতাস এমন বেগে বহিতেছে যে,বাগানের বড়ো বড়ো গাছের শাখা হেলিয়া ভূমি স্পর্শ করিতেছে। বন্যার মুখে ভগ্ন চূৰ্ণ গ্রামপল্লীর মতো ঝড়ের মুখে ছিন্নভিন্ন মেঘ ছুটিয়া চলিয়াছে। ঘন ঘন বিদ্যুৎ, ঘন ঘন গর্জন । উদয়াদিত্য চারি দিকের দ্বার রুদ্ধ করিয়া ছোটাে একটি মেয়েকে কোলে লইয়া বসিয়া আছেন । ঘরের প্রদীপ নিবাইয়া দিয়াছেন । ঘর অন্ধকার । মেয়েটি কোলের উপর ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। সুরমা যখন বঁাচিয়া ছিল, এই মেয়েটিকে অত্যন্ত ভালোবাসিত । সুরমার মৃত্যুর পর ইহার মা ইহাকে আর রাজবাড়িতে পাঠান নাই। অনেক দিনের পর সে আজ একবার রাজবাড়িতে বেড়াইতে আসিয়াছিল । সহসা উদয়াদিত্যকে দেখিয়া “কাক” “কাকা” বলিয়া সে র্তাহার কোলের উপর উদয়াদিত্যের মনের ভাব এই যে, সুরমা এই মেয়েটিকে যদি একবার দেখিতে আসে। ইহাকে যে সে বড়ো ভালোবাসিত। এত স্নেহের ছিল, সে কি না আসিয়া থাকিতে পারিবে। মেয়েটি একবার জিজ্ঞাসা করিল, “ককা, কাকীমা কোথায় ?” উদয়াদিত্য রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “একবার তাহাকে ডাক-না।” মেয়েটি “কাকীমা” “কাকীমা” করিয়া উকিতে লাগিল । উদ্যাদিত্যের মনে হইল, ঐ যেন কে সাড়া দিল। দূর হইতে ঐ যেন কে বলিয়া উঠিল, “এই যাই রে ।” যেন স্নেহের মেয়েটির করুণ আহবান শুনিয়া স্নেহময়ী আর থাকিতে পারিল না, তাহাকে বুকে তুলিয়া লইতে আসিতেছে। বালিকা কোলের উপর ঘুমাইয়া পড়িল। উদয়াদিত্য প্ৰদীপ নিবাইয়া দিলেন। একটি ঘুমন্ত মেয়েকে কোলে করিয়া অন্ধকার ঘরে একাকী বসিয়া রহিলেন । বাহিরে হু হু করিয়া বাতাস বহিতেছে। ইতস্তত খটু খটু করিয়া শব্দ হইতেছে। ঐ-না পদশব্দ শুনা