পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৬৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ტNტ პა. রবীন্দ্র-রচনাবলী গেল ? পদশব্দই বটে । বুক এমন দুড় দুড় করিতেছে যে, শব্দ ভালো শুনা যাইতেছে না। দ্বার খুলিয়া গেল, ঘরের মধ্যে দীপালোক প্রবেশ করিল। ইহাও কি কখনো সম্ভব । দীপ হস্তে চুপি চুপি ঘরে একটি স্ত্রীলোক প্রবেশ করিল। উদয়াদিত্য চক্ষু মুদ্রিত করিয়া কহিলেন, “সুরমা কি ?” পাছে সুরমাকে দেখিলে সুরমা চলিয়া যায়। পাছে সুরমা না হয় । রমণী প্ৰদীপ রাখিয়া কহিল, “কোন গা, আমাকে কি আর মনে পড়ে না ।” বজধ্বনি শুনিয়া যেন স্বপ্ন ভাঙিল। উদয়াদিত্য চমকিয়া উঠিয়া চক্ষু চাহিলেন । মেয়েটি জাগিয়া উঠিয়া “কাক” বলিয়া কঁাদিয়া উঠিল । তাহাকে বিছানার উপরে ফেলিয়া উদয়াদিত্য উঠিয়া দাড়াইলেন । কী করিবেন কোথায় যাইবেন যেন ভাবিয়া পাইতেছেন না । রুক্সিণী কাছে আসিয়া মুখ নাডিয়া কহিল, “বলি, এখন তো মনে পড়িবেই না । তবে এককালে কেন আশা দিয়া আকাশে তুলিয়াছিলে ?” উদয়াদিত্য চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিলেন, কিছুতেই কথা কহিতে পারিলেন না। তখন রুক্সিণী তাহার ব্ৰহ্মাস্ত্ৰ বাহির করিল । কাদিয়া কহিল, “আমি তোমার কী দোষ করিয়াছি, যাহাতে তোমার চক্ষুশূল হইলাম । তুমিই তো আমার সর্বনাশ করিয়াছ। যে রমণী যুবরাজকে একদিন দেহপ্রাণ বিকাইয়াছে সে আজ ভিখারিনীর মতো পথে পথে বেড়াইতেছে । এ পোড়া কপালে বিধাতা কি এই লিখিয়াছিল ?” এইবার উদয়াদিত্যের প্রাণে গিয়া আঘাত লাগিল । সহসা তাহার মনে হইল আমিই বুঝি ইহার সর্বনাশ করিয়াছি। অতীতের কথা ভুলিয়া গেলেন । ভুলিয়া গেলেন যৌবনের প্রমত্ত অবস্থায় রুক্মিণী কী করিয়া পদে পদে তাহাকে প্রলোভন দেখাইয়াছে, প্রতিদিন তাহার পথের সম্মুখে জাল পাতিয়া মুহূর্তের মধ্যে পাতালের অন্ধকারে নিক্ষেপ করিয়াছিল— সে সমস্তই ভুলিয়া গেলেন। দেখিলেন রুক্সিণীর বসন মলিন, ছিন্ন । রুক্সিণী কঁদিতেছে । করুণহাদয় উদয়াদিত কহিলেন, “তোমার কী চাই ?” রুক্সিণী কহিল, “আমার আর কিছু চাই না, আমার ভালোবাসা চাই । আমি ঐ বাতায়নে বসিয়া তোমার বুকে মুখ রাখিয়া তোমার সোহাগ পাইতে চাই। কেন গা, সুরমার চেয়ে কি এ মুখ কালো % যদি কালেই হইয়া থাকে তো সে তোমার জন্যই পথে পথে ভ্ৰমণ করিয়া । আগে তো কালো ছিল • ।।' এই বলিয়া রুক্সিণী উদয়াদিত্যের শয্যার উপর বসিতে গেল । উদয়াদিত্য আর থাকিতে পারিলেন না । কাতর হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ও বিছানায় বসিয়ে না, বসিয়ে না ।” রুক্সিণী আহত ফণিনীর মতো মাথা তুলিয়া বলিল, “কেন বসিব না ?” উদয়াদিত্য তাহার পথ রোধ করিয়া কহিলেন, “না, ও বিছানার কাছে তুমি যাইয়ো না । তুমি কী চাও আমি এখনই দিতেছি ।” রুক্মিণী কহিল, “আচ্ছা তোমার আঙুলের ঐ আংটিটি দাও।” উদয়াদিত্য তৎক্ষণাৎ তাহার হাত হইতে আংটি খুলিয়া ফেলিয়া দিলেন । রুক্মিণী কুড়াইয়া লইয়া বাহির হইয়া গেল। মনে ভাবিল ডাকিনীর মন্ত্রমোহ এখনো দূর হয় নাই, আরো কিছুদিন যাক, তাহার পর আমার মন্ত্র খাটিবে । রুক্সিণী চলিয়া গেলে উদয়াদিত্য শয্যার উপরে আসিয়া পড়িলেন । দুই বাহুতে মুখ ঢাকিয়া কঁাদিয়া কহিলেন, “কোথায়, সুরমা কোথায় । আজ আমার এ দগ্ধ বজাহত হৃদয়ে শান্তি দিবে কে ?”