পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট Nو কোনোমতেই প্ৰাণ ধরিয়া বলিতে পারেন না, “বিভা, তুই যা, তুই আর আসিস না, তোকে আর দেখিব না।” প্রত্যহ মনে করেন, কাল বলিব । কিন্তু সে কাল আর কিছুতেই আসিতে চায় না। অবশেষে একদিন দৃঢ় প্রতিজ্ঞা করিলেন । বিভা আসিল, বিভাকে বলিলেন, “বিভা, তুই আর এখানে থাকিস নে। তুই না গেলে আমি কিছুতেই শান্তি পাইতেছি না। প্রতিদিন সন্ধ্যাবেলায় এই কারাগৃহের অন্ধকারে কে আসিয়া আমাকে যেন বলে, বিভার বিপদ কাছে আসিতেছে। বিভা, আমার কােছ হইতে তোরা শীঘ্ৰ পালাইয়া যা । আমি শনিগ্ৰহ, আমার দেখা পাইলেই চারি দিক হইতে দেশে বিপদ ছুটিয়া আসে। তুই শ্বশুরবাড়ি যা । মাঝে মাঝে যদি সংবাদ পাই, তাহা হইলেই আমি সুখে থাকিব ।” বিভা চুপ করিয়া রহিল। উদয়াদিত্য মুখ নত করিয়া বিভার সেই মুখখানি অনেকক্ষণ ধরিয়া দেখিতে লাগিলেন। তাহার দুই চক্ষু দিয়া ঝরঝর করিয়া অশ্রু পড়িতে লাগিল। উদয়াদিত্য বুঝিলেন, “আমি কারাগার হইতে না মুক্ত হইলে বিভা কিছুতেই আমাকে ছাড়িয়া যাইবে না, কী করিয়া মুক্ত হইতে পারিব।” ষড়বিংশ পরিচ্ছেদ রামচন্দ্র রায় ভাবিলেন, বিভা যে চন্দ্ৰদ্বীপে আসিল না, সে কেবল প্রতাপাদিত্যের শাসনে ও উদয়াদিত্যের মন্ত্রণায় । বিভা যে নিজের ইচ্ছায় আসিল না, তাহা মনে করিলে তাহার আত্মগৌরবে: অত্যন্ত আঘাত লাগে । তিনি ভাবিলেন প্রতাপাদিত্য আমাকে অপমান করিতে চাহে, অতএব সে কখনো বিভাকে আমার কাছে পাঠাইবে না । কিন্তু এ অপমান আমিই তাহাকে ফিরাইয়া দিই না কেন ? আমিই তাহাকে এক পত্র লিখি না কেন যে তোমার মেয়েকে আমি পরিত্যাগ করিলাম, তাহাকে যেন আর চন্দ্ৰদ্বীপে পাঠানো না হয় । এইরূপ সাত-পাচ ভাবিয়া পাচজনের সহিত মন্ত্রণা করিয়া প্রতাপাদিত্যকে ঐ মর্মে এক পত্র লেখা হইল । প্রতাপাদিত্যকে এরূপ চিঠি লেখা বড়ো সাধারণ সাহসের কর্ম নহে। রামচন্দ্র রায়ের মনে মনে বিলক্ষণ ভয় হইতেছিল। কিন্তু ঢালু পর্বতে বেগে নামিতে নামিতে হাজার ভয় হইলেও যেমন মাঝে থামা যায় না, রামচন্দ্র রায়ের মনেও সেইরূপ একটা ভাবের উদয় হইয়াছিল । সহসা একটা দুঃসাহসিকতায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন, শেষ পর্যন্ত না পৌঁছিয়া যেন দাড়াইতে পারিতেছেন না । রামমোহনকে ডাকিয়া কহিলেন, “এই পত্র যশোহরে লইয়া যা ।” রামমোহন জোড়হস্তে কহিল, “আজ্ঞা না মহারাজ, আমি পারিব না । আমি স্থির করিয়াছি আর যশোহরে যাইব না। এক যদি পুনরায় মা-ঠাকুরানীকে আনিতে যাইতে বলেন তো আর-একবার যাইতে পারি, নতুবা এ চিঠি লইয়া যাইতে পারিব না।” রামমোহনকে আর কিছু না বলিয়া বৃদ্ধ নয়ানচাদের হাতে রাজা সেই পত্ৰখানি দিলেন । সে সেই পত্ৰ লইয়া যশোহরে যাত্ৰা করিল। পত্র লইয়া গেল বটে, কিন্তু নয়ানচাদের মনে বড়ো ভয় হইল। প্রতাপাদিত্যের হাতে এ পত্ৰ পড়িলে না জানি তিনি কী করিয়া বসেন । অনেক ভাবিয়া চিন্তিয়া মহিষীর হাতে সে এই পত্র দিতে সংকল্প করিল। মহিষীর মনের অবস্থা বড়ো ভালো নয় । এক দিকে বিভার জন্য র্তাহার ভাবনা, আর-এক দিকে উদয়াদিত্যের জন্য র্তাহার কষ্ট । সংসারের গোলেমালে তিনি যেন একেবারে ঝালাপালা হইয়া গিয়াছেন । মাঝে মাঝে প্রায় তাহাকে কঁদিতে দেখা যায় । তঁহার যেন আর ঘরকন্নায় মন লাগে না । এইরূপ অবস্থায় তিনি এই পত্ৰখানি পাইলেন— কী যে করিবেন কিছু ভাবিয়া পাইলেন না । বিভাকে কিছু বলিতে পারেন না, তাহা হইলে সুকুমার বিভা আর বঁচিবে না। মহারাজের কানে এ চিঠির কথা উঠিলে কী যে অনৰ্থপাত হইবে তাহার ঠিকানা নাই ! অথচ এমন সংকটের অবস্থায় কাহাকে কিছু না বলিয়া কাহারও নিকট কোনো পরামর্শ না লইয়া মহিষী বাচিতে পারেন না, চারি দিক অকুল পাথার দেখিয়া কঁাদিতে কঁাদিতে প্রতাপাদিত্যের কাছে গেলেন । কহিলেন, “মহারাজ, বিভার তো যাহা হয় একটা কিছু করিতে হইবে।” প্রতাপাদিত্য কহিলেন, “কেন বলে দেখি ?”