পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট Wり° ○ সেই মুহুর্তে সীতারাম কুটির হইতে বাহির হইয়া গেল। ক্রমে যখন রুক্মিণীর মুষ্টি শিথিল হইয়া আসিল, দাঁত খুলিয়া গেল, অধরোষ্ঠ পৃথক হইল, কুঞ্চিত ভু প্রসারিত হইল, তখন সে বসিয়া পড়িল, কহিল, “বটে ! যুবরাজ তোমারই বটে ! যুবরাজের বিপদ হইয়াছে বলিয়া তোমার গায়ে বড়ো লাগিয়াছে— যেন যুবরাজ আমার কেহ নয়। পোড়ারমুখো, এটা জানিস না যে সে আমারই যুবরাজ, আমিই তাহার ভালো করিতে পারি। আর আমিই তাহার মন্দ করিতে পারি। আমার যুবরাজকে তুই কারামুক্ত করিতে চাহিসী । দেখিব কেমন তাহা পারিস ।” - সীতারাম সেই দিনই রায়গড়ে চলিয়া গেল । বিকালবেলা বসন্ত রায় রায়গড়ের প্রাসাদের বারান্দায় বসিয়া রহিয়াছেন । সম্মুখে এক প্রশস্ত মাঠ দেখা যাইতেছে। মাঠের প্রান্তে খালের পরপরে একটি আম্রবনের মধ্যে সূর্য অস্ত যাইতেছেন। বসন্ত রায়ের হাতে র্তাহার চিরসহচর সেতারটি আর নাই। বৃদ্ধ সেই অস্তমান সূর্যের দিকে চাহিয়া আপনার মনে গুন গুন করিয়া গান গাহিতেছেন— আমিই শুধু রইনু বাকি । যা ছিল তা গেল চলে, রইল। যা তা কেবল ফাকি । আমার ব’লে ছিল যারা আর তো তারা দেয় না। সাড়াকোথায় তারা ? কোথায় তারা ? কেঁদে কেঁদে কারে ডাকি । বল দেখি মা শুধাই তোরে, আমার কিছু রাখলি নে রে ? আমি কেবল আমায় নিয়ে কোন প্ৰাণেতে বেঁচে থাকি । কে জানে কী ভাবিয়া বৃদ্ধ এই গান গাহিতেছিলেন । বুঝি তাহার মনে হইতেছিল, ‘গান গাহিতেছি, কিন্তু যাহাদের গান শুনাইতাম তাহারা যে নাই ! গান আপনি আসে, কিন্তু গান গাহিয়া যে আর সুখ নাই । এখনো আনন্দ ভুলি নাই, কিন্তু যখনই আনন্দ জন্মিত তখনই যাহাদের আলিঙ্গন করিতে সাধ যাইত তাহারা কোথায় ? যেদিন প্ৰভাতে রায়গড়ে ঐ তালগাছটার উপরে মেঘ করিত, মনটা আনন্দে নাচিয়া উঠিত, সেই দিনই আমি যাহাদের দেখিতে যশোরে যাত্ৰা করিতাম, তাহদের কি আর দেখিতে পাইব না ? এখনো এক-একবার মনটা তেমনি আনন্দে নাচিয়া উঠে, কিন্তু হায়—’ এই-সব বুঝি ভাবিয়া আজ বিকালবেলায় অস্তমান সূর্যের দিকে চাহিয়া বৃদ্ধ বসন্ত রায়ের মুখে আপনা-আপনি গান উঠিতেছে- আমিই শুধু রইনু বাকি । এমন সময়ে খ্যা সাহেব আসিয়া এক মস্ত সেলাম করিল । খ্যা সাহেবকে দেখিয়া বসন্ত রায় উৎফুল্ল হইয়া কহিলেন, “খা সাহেব, এসো এসো ।” অধিকতর নিকটে গিয়া ব্যস্তসমস্ত হইয়া কহিলেন, "সাহেব, তোমার মুখ অমন মলিন দেখিতেছি। কেন ? মেজাজ ভালো আছে তো ?” খা। সাহেব । মেজাজের কথা আর জিজ্ঞাসা করিবেন না, মহারাজ। আপনাকে মলিন দেখিয়া আমাদের মনে আর সুখ নাই। একটি বয়েত আছে— রাত্রি বলে আমি কেহই নই, আমি যাহাকে মাথায় করিয়া রাখিয়াছি সেই চাদ, তাহারই সহিত আমি একত্রে হাসি, একত্রে স্নান হইয়া যাই ! মহারাজ, আমরাই বা কে, আপনি না হাসিলে আমাদের হাসিবার ক্ষমতা কী ? আমাদের আর সুখ নাই, জনাব । বসন্ত রায় ব্যগ্ৰ হইয়া কহিলেন, “সে কী কথা সাহেব ? আমার তো অসুখ কিছুই নাই, আমি নিজেকে দেখিয়া নিজে হাসি, নিজের আনন্দে নিজে থাকি, আমার অসুখ কী খ্যা সাহেব ?” স্বী সাহেব ! মহারাজ এখন আপনার আর তেমন গান বাদ্য শুনা যায় না । Ꭹ | | 8Ꮤ2