পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭০৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট \۹( বসন্ত রায় । সে একলা কারাগারে বসিয়া আছে ? বসন্ত রায় এ কথাগুলি বিশেষ কোনো ব্যক্তিকে জিজ্ঞাসা করেন নাই- আপনা-আপনি বলিতেছিলেন। সীতারাম তাহা বুঝিতে পারে নাই— সে উত্তর করিল, “ই মহারাজ ।” বসন্ত রায় বলিয়া উঠিলেন, "দাদা, তুই আমার কাছে আয় রে, তোকে কেহ চিনিল না।” অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ বসন্ত রায় তাহার পরদিনই যশোহরে যাত্ৰা করিলেন । কাহারও নিষেধ মানিলেন না । যশোহরে পৌছিয়াই একেবারে রাজবাটীর অন্তঃপুরে গেলেন । বিভা সহসা তাহার দাদামহাশয়কে দেখিয়া যেন কী হইয়া গেল। কিছুক্ষণ কী যে করিবে কিছু যেন ভাবিয়া পাইল না । কেবল চোখে বিস্ময়, অধরে আনন্দ, মুখে কথা নাই, শরীর নিম্পন্দ— খানিকটা দাড়াইয়া রহিল, তাহার পর তাহার পায়ের কাছে পড়িয়া প্ৰণাম করিল, পায়ের ধুলা মাথায় লইল । বিভা উঠিয়া দাড়াইলে পর বসন্ত রায় একবার নিতান্ত একাগ্ৰদূষ্ট বিভার মুখের দিকে চাহিয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা ?” আর কিছু বলিলেন না, কেবল জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা ?” যেন তাহার মনে একটি অতি ক্ষীণ আশা জাগিয়াছিল যে, সীতারাম যাহা বলিয়াছিল তাহা সত্য না হইতেও পারে । সমস্তটা স্পষ্ট জিজ্ঞাসা করিতে ভয় হইতেছে, পাছে বিভা তাহার উত্তর দিয়া ফেলে । তাহার ইচ্ছা নয় যে, বিভা তৎক্ষণাৎ তাহার এ প্রশ্নের উত্তর দেয় । তাই তিনি অতি ভয়ে ভয়ে বিভার মুখখানিকে জিজ্ঞাসা করিলেন, “বিভা ?” তাই তিনি অতি একাগ্রদূদ্ষ্টে তাহার মুখের দিকে একবার চাহিলেন । বিভা বুঝিল এবং বিভা উত্তর দিতেও পারিল না ; তাহার প্রথম আনন্দ-উচ্ছাস ফুরাইয়া গেছে । আগে যখন দাদামহাশয় আসিতেন, সেই-সব দিন তাহার মনে পডিয়াছে । সে এক কী উৎসবের দিনই গিয়াছে । তিনি আসিলে কী একটা আনন্দই পড়িত । দাদামহাশয়ের গান শুনিতেন । আজ দাদামহাশয় আসিলেন, কিন্তু আর কেহ তাহার কাছে আসিল না, কেবল এই আঁধার সংসারে একলা বিভা— সুখের সংসারের একমাত্র ভগ্নাবশেষের মতো একলা দাদামহাশয়ের কাছে দাড়াইয়া আছে। দাদামহাশয় আসিলে যে ঘরে আনন্দধ্বনি উঠিত— সেই সুরমার ঘর আজ এমন কেন ? সে আজ স্তব্ধ, অন্ধকার, শূন্যময়— দাদামহাশয়কে দেখিলেই সে ঘরটা যেন এখনই কঁাদিয়া উঠিবে । বসন্ত রায় একবার কী যেন কিসের আশ্বাসে সেই ঘরের সম্মুখে গিয়া দাড়াইলেন— দরজার কাছে দাড়াইয়া ঘরের মধ্যে মাথা লইয়া একবার চারি দিক দেখিলেন, তৎক্ষণাৎ মুখ ফিরাইয়া বুক-ফাটা কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করিলেন, “দিদি, ঘরে কি কেহই নাই ।” স্তব্ধ ঘরটা যেন হা হা করিয়া বলিয়া উঠিল, “আগে যাহারা ছিল তাহারা কেহই নাই ।” বসন্ত রায় অনেকক্ষণ পর্যন্ত চুপ করিয়া দাড়াইয়া রহিলেন, অবশেষে বিভার হাত ধরিয়া আস্তে আস্তে গাহিয়া উঠিলেন আমিই শুধু রইনু বাকি । বসন্ত রায় প্রতাপাদিত্যের কাছে গিয়া নিতান্ত মিনতি করিয়া কহিলেন, “বাবা প্ৰতাপ, উদয়কে আর কেন কষ্ট দাও— সে তোমাদের কী করিয়াছে ? তাহাকে যদি তোমরা ভালো না বাস, পদে পদেই যদি সে তোমাদের কাছে অপরাধ করে তবে তাহাকে এই বুড়ার কাছে দাও-না। আমি তাহাকে লইয়া সুন্টু ভূমি তাহাকে রাখিয়া দিই। তাহাক আর তোমাদের দেখিতে হইবে না- সে আমার কাছে প্রতাপাদিত্য অনেকক্ষণ পর্যন্ত ধৈৰ্য ধরিয়া চুপ করিয়া বসন্ত রায়ের কথা শুনিলেন, অবশেষে