পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

\ՆԳԵ՛ রবীন্দ্র-রচনাবলী সীতারাম । আজ্ঞা না, আর সময় নাই । বসন্ত রায় । কোথায় যাইতে হইবে ? সীতারাম । আমার সঙ্গে আসুন, আমি লইয়া যাইতেছি । বসন্ত রায় উঠিয়া দাড়াইয়া কহিলেন, “একবার বিভার সঙ্গে দেখা করিয়া আসি-না কেন ?” সীতারাম । আজ্ঞা না মহারাজ । দেরি হইলে সমস্ত নষ্ট হইয়া যাইবে । , বসন্ত রায় তাড়াতাড়ি কহিলেন, “তবে কাজ নাই- কাজ নাই ।” উভয়ে চলিলেন । আবার কিছু দূর গিয়া কহিলেন, “একটু বিলম্ব করিলে কি চলে না ?” সীতারাম । না মহারাজ, তাহা হইলে বিপদ হইবে । “দুৰ্গা বলো” বলিয়া বসন্ত রায় প্রাসাদের বাহির হইয়া গেলেন । বসন্ত রায় যে আসিয়াছেন, তাহা উদয়াদিত্য জানেন না । বিভা তাহাকে বলে নাই । কেননা যখন উভয়ের দেখা হইবার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। তখন এ সংবাদ তাহার কষ্টের কারণ হইত। সন্ধ্যার পর বিদায় লইয়া বিভা কারাগার হইতে চলিয়া গিয়াছে। উদয়াদিত্য একটি প্ৰদীপ লইয়া একখানি সংস্কৃত গ্রন্থ পড়িতেছেন। জানালার ভিতর দিয়া বাতাস আসিতেছে, দীপের ক্ষীণ শিখা কঁাপিতেছে, অক্ষর ভালো দেখা যাইতেছে না | কীটপতঙ্গ আসিয়া দীপের উপর পড়িতেছে। এক-একবার দীপ নিভো-নিভে হইতেছে। একবার বাতাস বেগে আসিল— দীপ নিভিয়া গেল । উদয়াদিত্য পুঁথি। বঁাপিয়া তাহার খাটে গিয়া বসিলেন । একে একে কত কী ভাবনা আসিয়া পড়িল । বিভার কথা মনে আসিল । আজ বিভা কিছু দেরি করিয়া আসিয়াছিল, কিছু সকাল সকাল চলিয়া গিয়াছিল। আজ বিভাকে কিছু বিশেষ স্নান দেখিয়াছিলেন ; তাহাই লইয়া মনে মনে আলোচনা করিতেছিলেন । পৃথিবীতে যেন তাহার আর কেহ নাই। সমস্ত দিন বিভাকে ছাড়া আর কাহাকেও দেখিতে পান না। বিভাই তাহার একমাত্র আলোচ্য | বিভার প্রত্যেক হাসিটি প্রত্যেক কথাটি তাহার মনে সঞ্চিত হইতে থাকে। তৃষিত ব্যক্তি তাহার পানীয়ের প্রত্যেক বিন্দুটি পর্যন্ত যেমন উপভোগ করে তেমনি বিভার গ্ৰীতির অতি সামান্য চিহ্নটুকু পর্যন্ত তিনি প্ৰাণ-মনে উপভোগ করেন। আজ তাই এই বিজন ক্ষুদ্র অন্ধকার ঘরের মধ্যে একলা শুইয়া মেহের প্রতিমা বিভার স্নান মুখখানি ভাবিতেছিলেন । সেই অন্ধকারে বসিয়া তাহার একবার মনে হইল, “বিভার কি ক্রমেই বিরক্তি ধরিতেছে ? এই নিরানন্দ কারাগারের মধ্যে এক বিষগ্ন অন্ধকার মূর্তির সেবা করিতে আর কি তাহার ভালো লাগিতেছে না ? আমাকে কি ক্রমেই সে তাহার সুখের বাধা, তাহার সংসারপথের কণ্টক বলিয়া দেখিবে ? আজ দেরি বসিয়া আছি কখন বিভা আসিবে- বিকাল হইল, সন্ধ্যা হইল- রাত্ৰি হইল, বিভা আর আসিল না ।- তাহার পর হইতে আর হয়তো বিভা আসিবে না ।” উদয়াদিত্যের মনে যতই এই কথা উদয় হইতে লাগিল ততই তাহার মনটা হা হা করিতে লাগিল— তাহার কল্পনারাজ্যের চারি দিক কী ভয়ানক শূন্যময় দেখিতে লাগিলেন। একদিন আসিবে যেদিন বিভা তীহাকে স্নেহশূন্য নয়নে তাহার সুখের কণ্টক বলিয়া দেখিবে- সেই অতিদূর কল্পনার আভাসমােত্র লাগিয়া তাহার হৃদয় একেবারে ব্যাকুল হইয়া উঠিল । একবার মনে করিতেছেন, “আমি কী ভয়ানক স্বার্থপর । আমি বিভাকে ভালোবাসি বলিয়া তাহার যে ঘোরতর শক্ৰতা করিতেছি। কোনো শত্রুও বোধ করি এমন পারে না ।” বার বার করিয়া প্ৰতিজ্ঞা করিতেছেন আর বিভার উপর নির্ভর করিবেন না । কিন্তু যখনই কল্পনা করিতেছেন তিনি বিভাকে হারাইয়াছেন তখনই তাহার মনের সে বল চলিয়া যাইতেছে, তখনই তিনি অকূল পাথরে পড়িয়া যাইতেছেন- মরণাপন্ন মজমান ব্যক্তির মতো বিভার কাল্পনিক মূর্তিকে আকুলভাবে আঁকড়িয়া ধরিতেছেন । এমন সময়ে বহির্দেশে সহসা “আগুন আগুন” বলিয়া এক ঘোরতর কোলাহল উঠিল । উদয়াদিত্যের বুক কঁপিয়া উঠিল । সহসা নানা কণ্ঠের নানাবিধ চীৎকার আকাশে উঠিল— বাহিরে শত