পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭১৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট VbrV) আনিবাৰ্য আবেগ উপস্থিত হইল— কিন্তু সময় নাই দেখিয়া সে আবেগ দমন করিয়া হন হন করিয়া 5व्लिब् । সীতারাম রুক্মিণীর কুটিরের নিকটে গিয়া দেখিল, দ্বার খোলাই আছে। হৃষ্টচিত্তে কুটিরের মধ্যে প্রবেশ করিয়া একবার চারি দিকে নিরীক্ষণ করিল। ঘোরতর অন্ধকার— কিছুই দেখা যাইতেছে না। একবার চারি দিক হাতড়াইয়া দেখিল । একটা সিন্দুকের উপর হুঁচট খাইয়া পড়িয়া গেল, দুই-একবার দেয়ালে মাথা ঠুকিয়া গেল। সীতারামের গা ছমছম করিতে লাগিল । মনে হইল, কে যেন ঘরে আছে। কাহার যেন নিশ্বাসপ্রশ্বাস শুনা যাইতেছে- আস্তে আস্তে পাশের ঘরে গেল। গিয়া দেখিল, রুক্সিণীর শয়নগুহ হইতে আলো আসিতেছে। প্ৰদীপটা এখনো জ্বলিতেছে মনে করিয়া সীতারামের অত্যন্ত আনন্দ হইল। তাড়াতাড়ি সেই ঘরের দিকে গেল । ও কে ও ! ঘরে বসিয়া কে ! বিনিদ্রনয়নে চুপ করিয়া বসিয়া কে ও রমণী থরথর করিয়া কাপিতেছে! অর্ধবৃত দেহে ভিজা কাপড় জড়ানাে, এলোচুল দিয়া ফোটা ফোটা করিয়া জল পড়িতেছে। কঁাপিতে কঁাপিতে তাহার দাঁত ঠক ঠক করিতেছে। ঘরে একটিমাত্ৰ প্ৰদীপ জ্বলিতেছে। সেই প্ৰদীপের ক্ষীণ আলো তাহার পাংশুবৰ্ণ মুখের উপর পড়িতেছে, পশ্চাতে সেই রমণীর অতি বৃহৎ এক ছায়া দেওয়ালের উপর পড়িয়াছে— ঘরে আর কিছুই নাই— কেবল সেই পাংশু মুখশ্ৰী সেই দীর্ঘ ছায়া আর এক ভীষণ নিস্তব্ধতা। ঘরে প্রবেশ করিয়াই সীতারামের শরীর হিম হইয়া গেল । দেখিল ক্ষীণ আলোকে, এলোচুলে, ভিজা কাপড়ে সেই মঙ্গলা বসিয়া আছে। সহসা দেখিয়া তাহাকে প্রেতিনী বলিয়া বোধ হইল । অগ্রসর হইতেও সীতারামের সাহসী হইল না— ভরসা বাধিয়া পিছন ফিরিতেও পাইল না | সীতারাম নিতান্ত ভীরু ছিল না, অল্পীক্ষণ স্তব্ধভাবে দাড়াইয়া অবশেষে একপ্রকার বাহ্যিক সাহস ও মৌখিক উপহাসের স্বরে কহিল, “তুই কোথা হইতে মাগী । তোর মরণ নাই নাকি।” রুক্মিণী কটমট করিয়া খানিকক্ষণ সীতারামের মুখের দিকে চাহিয়া রহিল— তখন সীতারামের প্রাণটা তাহার কণ্ঠের কাছে আসিয়া ধুকধুক করিতে লাগিল । অবশেষে রুক্মিণী সহসা বলিয়া উঠিল, “বটে । তোদের এখনো সর্বনাশ হইল না, আর আমি মরিব !” উঠিয়া দাডাইয়া হাত নাড়িয়া কহিল, “যমের দুয়ার হইতে ফিরিয়া আসিলাম, আগে তোকে আর যুবরাজকে চুলায় শুয়াইব, তোদের চুলা হইতে দু-মুঠ ছাই লইয়া গায়ে মাখিয়া দেহ সার্থক করিব— তার পরে যমের সাধ মিটাইব । তাহার আগে যমালয়ে আমার ঠাই নাই ।” কক্সিণীর গলা শুনিয়া সীতারামের অত্যন্ত সাহসী হইল । সে সহসা অত্যন্ত অনুরাগ দেখাইয়া রুক্মিণীর সহিত ভাব করিয়া লইবার চেষ্টা করিতে লাগিল । খুব যে কাছে ঘেষিয়া গেল তাহা নহে, অপেক্ষাকৃত কাছে আসিয়া কোমল স্বরে কহিল, “মাইরি ভাই, ঐজন্যই তো রাগ ধরে । তোমার কখন যে কী মতি হয়, ভালো বুঝতে পারি না । বল তো মঙ্গলা, আমি তোর কী করেছি। অধীনের প্রতি এত অপ্ৰসন্ন কেন ? মান করেছিস বুঝি ভাই ? সেই গানটা গাব ?” সীতারাম যতই অনুরাগের ভান করিতে লাগিল, রুক্মিণী ততই ফুলিয়া উঠিতে লাগিল। তাহার আপাদমস্তক রাগে জ্বলিতে লাগিল— সীতারাম যদি তাহার নিজের মাথার চুল হইত, তবে তাহা দুই হাতে পাটুপটু করিয়া ছিড়িয়া ফেলিতে পারিত। সীতারাম যদি তাহার নিজের চােখ হইত, তবে তৎক্ষণাৎ তাহা নখ দিয়া উপড়াইয়া পা দিয়া দলিয়া ফেলিতে পারিত । চারি দিকে চাহিয়া দেখিল কিছুই হাতের কাছে পাইল না। দাতে দাঁতে লাগাইয়া কহিল, “একটু রোসো, তোমার মুণ্ডপাত করিতেছি।” বলিয়া থারথার করিয়া কঁাপিতে কঁাপিতে বঁটির অন্বেষণে পাশের ঘরে চলিয়া গেল। এই কিছুক্ষণ হইল— সীতারাম গলায় চাদর বাধিয়া রূপক অলংকারে মরিবার প্রস্তাব উত্থাপিত করিয়াছিল, কিন্তু রুক্মিণীর চেহারা দেখিয়া তাহার রূপক ঘুরিয়া গেল এবং চৈতন্য হইল যে সত্যকার বঁটির আঘাতে মরিতে এখনো সে প্রস্তুত হইতে পারে নাই, এই নিমিত্ত অবসর বুঝিয়া তৎক্ষণাৎ কুটিরের বাহিরে সরিয়া পড়িল। রুক্মিণী বঁটহস্তে শূন্যগৃহে আসিয়া ঘরের মেজেতে সীতারামের উদ্দেশে বার বার আঘাত করিলা । রুক্মিণী এখন মরিয়া হইয়াছে। যুবরাজের আচরণে তাহার দুরাশা একেবারে ভাঙিয়া গিয়াছে—