পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Vobrbr রবীন্দ্র-রচনাবলী আমি সেই নীেকায় মাঝি ছিলাম, মহারাজ ।” শীতল সর্দার আসিয়া কহিল, “মহারাজ, আপনি যখন রায়গড়ে ছিলেন, তখন আমার লাঠিখেলা দেখিয়া বকশিশ দিয়াছিলেন, আজ ইচ্ছা আছে একবার আমার ছেলেদের খেলা মহারাজকে দেখাইব । এসো তো ব্যাপাধন, তোমরা এগোও তো ।” বলিয়া ছেলেদের ডাকিল । এইরূপ প্রত্যহ সকাল হইলে উদয়াদিত্যের কাছে দলে দলে প্ৰজারা আসিত ও সকলে একত্রে মিলিয়া কথা কহিত । এইরূপ মেহের মধ্যে, গাছপালার মধ্যে, আনন্দের মধ্যে, গীতোচ্ছাসের মধ্যে থাকিয়া স্বভাবতই উদয়াদিত্যের মন হইতে ভাবনা অনেকটা শিথিল হইয়া আসিল । তিনি চোখ বুজিয়া মনে করিলেন, পিতা হয়তো রাগ করেন নাই, তিনি হয়তো সন্তুষ্ট হইয়াছেন, নহিলে এতদিন আর কি কিছু করিতেন କn] | কিন্তু এরূপ চোখ-বাধা বিশ্বাসে বেশিদিন মনকে ভুলইয়া রাখিতে পারিলেন না । তাহার দাদামহাশয়ের জন্য মনে কেমন একটা ভয় হইতে লাগিল । যশোহরে ফিরিয়া যাইবার কথা দাদামহাশয়কে বলা বৃথা ; তিনি স্থির করিলেন— একদিন লুকাইয়া যশোহরে পলাইয়া যাইব । আবার সেই কারাগার মনে পড়িল । কোথায় এই আনন্দের স্বাধীনতা আর কোথায় সেই সংকীর্ণ ক্ষুদ্র কারাগারের একঘেয়ে জীবন । কারাগারের সেই প্ৰতিমুহূর্তকে এক-এক বৎসর রূপে মনে পড়িতে লাগিল। সেই নিরালোক, নির্জন, বায়ুহীন, বদ্ধ ঘরটি কল্পনায় স্পষ্ট দেখিতে পাইলেন, শরীর শিহরিয়া উঠিল । তবুও স্থির করিলেন, এখান হইতে একদিন সেই কারাগারের অভিমুখে পলাইতে হইবে । আজই পলাইব- এমন কথা মনে করিতে পারিলেন না । একদিন পলাইব- মনে করিয়া অনেকটা নিশ্চিন্ত হইলেন । আজ বৃহস্পতিবার, বারবেলা, আজ যাত্রা হইতে পারে না, কাল হইবে । আজ দিন বড়ো খারাপ { সকাল হইতে ক্ৰমাগত টিপ টিপ করিয়া বৃষ্টি হইতেছে। সমস্ত আকাশ লেপিয়া মেঘ করিয়া আছে। আজ সন্ধ্যাবেলা রায়গড় ছাড়িয়া যাইতেই হইবে বলিয়া উদয়াদিত্য স্থির করিয়া রাখিয়াছেন । সকালে যখন বসন্ত রায়ের সঙ্গে তাহার দেখা হইল, তখন বসন্ত রায় উদয়াদিত্যকে জড়াইয়া ধরিয়া কহিলেন, “দাদা, কাল রাত্রে আমি একটা বড়ো দুঃস্বপ্ন দেখিয়াছি । স্বপ্নটা ভালো মনে পড়িতেছে না, কেবল মনে আছে, তোতে আমাতে যেন— যেন জন্মের মতো ছাড়াছাড়ি হইতেছে।” উদয়াদিত্য বসন্ত রায়ের হাত ধরিয়া কহিলেন, “না, দাদামহাশয় । ছাড়াছাড়ি যদি বা হয় তো জন্মের মতো কেন হইবে ?” বসন্ত রায় অন্য দিকে চাহিয়া ভাবনার ভাবে কহিলেন, “তা নয় তো আর কী । কতদিন আর বঁাচিব বল, বুড়া হইয়াছি।” গত রাত্রের দুঃস্বপ্নের শেষ তান এখনো বসন্ত রায়ের মনের গুহার মধ্যে প্রতিধ্বনিত হইতেছিল, তাই তিনি অন্যমনস্ক হইয়া কী ভাবিতেছিলেন । উদয়াদিত্য কিছুক্ষণ চুপ করিয়া থাকিয়া বলিলেন, “দাদামহাশয়, আবার যদি আমাদের ছাড়াছাড়ি হয় তো কী হইবে।” : ছাড়িয়া যাস নে । এ বুড়া বয়সে তুই আমাকে ফেলিয়া পালাস নে ভাই ।” উদয়াদিত্যের চোখে জল আসিল । তিনি বিস্মিত হইলেন, তাহার মনের অভিসন্ধি যেন বসন্ত রায় কী করিয়া টের পাইয়াছেন । নিশ্বাস ফেলিয়া কহিলেন, “আমি কাছে থাকিলেই যে তোমার বিপদ ঘটিবে দাদামহাশয় ।” বসন্ত রায় হাসিয়া কহিলেন, “কিসের বিপদ ভাই ? এ বয়সে কি আর বিপদকে ভয় করি । মরণের বাড়া তো আর বিপদ নাই। তা মরণ যে আমার প্রতিবেশী । সে নিত্য আমার তত্ত্ব লইতে পাঠায়, তাহাকে আমি ভয় করি না। যে ব্যক্তি জীবনের সমস্ত বিপদ অতিক্রম করিয়া বুড়া বয়স পর্যন্ত বঁচিয়া থাকিতে পারে, তীরে আসিয়া তাহার নীেকাডুবি হইলই বা !”