পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭২৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

বউ-ঠাকুরানীর হাট ৬৯৭ বিভা কহিল, “না মোহন, আমি আজই একবার তাহাকে দেখিয়া আসিব ।” রামমোহন কহিল, “যুবরাজ আগে গ্রাম হইতে ফিরিয়া আসুন।” বিভা কহিল, “না মোহন, আমি এখনই একবার যাই।” বিভা মনে করিয়াছিল, উদয়াদিত্য এ সংবাদ শুনিলে অপমানের ভয়ে পাছে না। যাইতে দেন । রামমোহন কহিল, “তবে একখানি শিবিকা আনাই।” বিভা কহিল, “শিবিক কেন ? আমি কি রানী যে শিবিক চাই। আমি একজন সামান্য প্রজার মতো, একজন ভিখারিনীর মতো যাইব, আমার শিবিকায় কাজ কী ?” রামমোহন কহিল, “আমার প্রাণ থাকিতে আমি তাহা দেখিতে পারিব :া ।” বিভা কাতর স্বরে কহিল, “মােহন, তাের পায়ে পড়ি, আমাকে আর বাধা দিস নে, বিলম্ব হইয়া যাইতেছে ।” রামমোহন ব্যথিতহাদয়ে কহিল, “আচ্ছা মা, তাহাই হউক ৷” বিভা সামান্য রমণীর বেশে নীেকা হইতে বাহির হইল। নীেকার ভূত্যেরা আসিয়া কহিল, “এ কী মা, এমন করিয়া এ বেশে কোথায় যাও !” রামমোহন কহিল, “এ তো মায়েরই রাজ্য, যেখানে ইচ্ছা সেইখানেই যাইতে পারেন ।” ভূত্যেরা আপত্তি করিতে লাগিল, রামমোহন তাহাদের ভাগাইয়া দিল । সপ্তাত্রিংশ পরিচ্ছেদ চারি দিকে লোকজন, চারি দিকেই ভিড় । আগে হইলে বিভা সংকোচে মরিয়া যাইত, আজ কিছুই যেন তাহার চোখে পড়িতেছে না। যাহা কিছু দেখিতেছে। সমস্ত যেন বিভার মিথ্যা বলিয়া মনে হইতেছে। চারিদিকে যেন একটা কোলাহলময় স্বপ্নের ঘেঁষাৰ্ঘেষি— কিছুই যেন কিছু নয়। চারি দিকে একটা ভিড় চোখে পড়িতেছে এই পর্যন্ত, চারি দিক হইতে একটা কোলাহল শোনা যাইতেছে এই পর্যন্ত, তাহার যেন একটা কোনো অর্থ নাই । ভিড়ের মধ্য দিয়া রাজপুরীর দ্বারের নিকট আসিতেই একজন দ্বারী সহসা বিভার হাত ধরিয়া বিভাকে নিবারণ করিল, তখন সহসা বিভা একমুহূর্তে বাহ্য জগতের মধ্যে আসিয়া পড়িল, চারি দিক দেখিতে পাইল, লজ্জায় মরিয়া গেল। তাহার ঘোমটা খুলিয়া গিয়াছিল, তাড়াতাড়ি মাথার ঘোমটা তুলিয়া দিল । রামমোহন আগে আগে যাইতেছিল, সে পশ্চাৎ ফিরিয়া দ্বারীর প্রতি চোখ পাকাইয়া দীড়াইল। অদূরে ফর্নাণ্ডিজ ছিল, সে আসিয়া দ্বারীকে ধরিয়া বিলক্ষণ শাসন করিল। বিভা প্রাসাদে না । ঘরে কেবল রাজা ও রামাই ভাড় বসিয়াছিলেন । বিভা গৃহে প্রবেশ করিয়া রাজার মুখের দিকে "কে তুই ? ভিখারিনী ? ভিক্ষা চাহিতে আসিয়াছিস ?” বিভা নত মুখ তুলিয়া অশ্রুপূর্ণনেত্রে রাজার মুখের দিকে চাহিয়া কহিল, “না মহারাজ, আমার সর্বস্ব দান করিতে আসিয়াছি। আমি তোমাকে পরের হাতে সমর্পণ করিয়া বিদায় লইতে আসিয়াছি।” রামমোহন থাকিতে পারিল না, কাছে আসিয়া কহিল, “মহারাজ, আপনার মহিষী- যশোহরের রাজকুমারী ן" সহসা রামচন্দ্র রায়ের প্রাণ যেন কেমন চমকিয়া উঠিল। কিন্তু তৎক্ষণাৎ রামাই ভাড় হাসিয়া রাজার দিকে কটাক্ষ করিয়া কঠোর কণ্ঠে কহিল, “কেন, এখন কি আর দাদাকে মনে ধরে না নাকি ?” রামচন্দ্র রায়ের হৃদয়ে করুণার আভাস জাগিয়া উঠিয়াছিল, তথাপি রমাইয়ের কথায় তিনি নিষ্ঠুর