পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ o@ গেলেন। অন্যমনে স্নান করিতে করিতে ঐ প্রশ্নই ভাবিতে লাগিলেন। হাসি জলে আঁচল ভিজাইয়া সিঁড়িতে বসিয়া ধীরে ধীরে রক্তের রেখা মুছতে লাগিল, তাহার দেখাদেখি ছোটাে হাত দুটি দিয়া তাতাও তাঁহাই করিতে লাগিল। হাসির আঁচলখানি রক্তে লাল হইয়া গেল। রাজার যখন স্নান হইয়া গেল, তখন দুই ভাইবােনে মিলিয়া রক্তের দাগ মুছিয়া ফেলিয়াছে। সেইদিন বাড়ি ফিরিয়া গিয়া হাসির জ্বর হইল। তাতা কাছে বসিয়া দুটি ছােটাে আঙুলে দিদির মুদ্রিত চোখের পাতা খুলিয়া দিবার চেষ্টা করিয়া মাঝে মাঝে ডাকিতেছে, “দিদি !” দিদি আমনি সচকিতে একটুখানি জাগিয়া উঠিতেছে। “কী তাতা” বলিয়া তাহাকে কাছে টানিয়া লইতেছে ; আবার তাহার চোখ ঢুলিয়া পড়িতেছে। তাত অনেকক্ষণ ধরিয়া চুপ করিয়া দিদির মুখের দিকে চাহিয়া থাকে, কোনো কথাই বলে না। অবশেষে অনেকক্ষণ পরে ধীরে ধীরে দিদির গলা জড়াইয়া ধরিয়া দিদির মুখের কাছে মুখ দিয়া আস্তে আস্তে বলিল, “দিদি, তুই উঠিবি নে ?” হাসি চমকিয়া জাগিয়া তাতাকে বুকে চাপিয়া কহিল, “কেন উঠব না। ধন !” কিন্তু দিদির উঠিবার আর সাধা নাই। তাতার ক্ষুদ্র হৃদয় যেন অত্যন্ত অন্ধকার হইয়া গেল। তাতার সমস্ত দিনের খেলাধুলা আনন্দের আশা একেবারে স্নান হইয়া গেল। আকাশ অত্যন্ত অন্ধকার, ঘরের চালের উপর ক্রমাগতই বৃষ্টির শব্দ শুনা যাইতেছে, প্রাঙ্গণের তেঁতুল গাছ জলে ভিজিতেছে, পথে পথিক নাই । কেদারেশ্বর একজন বৈদ্যাকে সঙ্গে করিয়া আনিল । বৈদ্য নাড়ি টিপিয়া অবস্থা দেখিয়া ভালো বোধ করিল না । তাহার পরদিন সুসান করিতে আসিয়া রাজা দেখিলেন, মন্দিরে দুইটি ভাইবোন তাহার অপেক্ষায় বসিয়া নাই। মনে করিলেন এই ঘোরতর বর্ষায় তাহারা আসিতে পারে নাই । স্নান-তপণ শেষ করিয়া শিবিকায় চড়িয়া বাহকদিগকে কেদারেশ্বরের কুটিরে যাইতে আজ্ঞা দিলেন । অনুচরেরা সকলে আশ্চর্য হইয়া গেল, কিন্তু রাজাজ্ঞার উপরে আর কথা কহিতে পারিল না । রাজার শিবিক প্রাঙ্গণে গিয়া পৌছিলে কুটিরে অত্যন্ত গোলযোগ পড়িয়া গেল । সে গোলমালে রোগীর রোগের কথা সকলেই ভুলিয়া গেল ! কেবল তাত নড়িল না, সে অচেতন দিদির কোলের কাছে বসিয়া দিদির কাপড়ের এক প্রান্ত মুখের ভিতর পুরিয়া চুপ করিয়া চাহিয়া রহিল । রাজাকে ঘরে আসিতে দেখিয়া তাতা জিজ্ঞাসা করিল, “কী হয়েছে ?” খুড়ো কেদারেশ্বর কিছু বিরক্ত হইয়া উত্তর দিল, “হা, লেগেছে।” অমনি তাতা দিদির কাছে গিয়া দিদির মুখ তুলিয়া ধরিবার চেষ্টা করিয়া গলা জড়াইয়া জিজ্ঞাসা মনের অভিপ্ৰায় এই যে, সেই জায়গাটাতে ফু দিয়া, হাত বুলাইয়া, দিদির সমস্ত বেদনা দূর করিয়া দিবে। কিন্তু যখন দিদি কোনো উত্তর দিল না। তখন তাহার আর সহ্য হইল না— ছোটাে দুইটি ঠোঁট উত্তরোত্তর ফুলিতে লাগিল, অভিমানে কঁাদিয়া উঠিল। কাল হইতে বসিয়া আছে, একটি কথা নাই কেন ! তাত কী করিয়াছে যে তাহার উপর এত অনাদর !! রাজার সম্মুখে তাতার এইরূপ ব্যবহার দেখিয়া কেদারেশ্বর অত্যন্ত শশব্যস্ত হইয়া উঠিল । সে বিরক্ত হইয়া তাতার হাত ধরিয়া অন্য ঘরে টানিয়া লইয়া গেল। তবুও দিদি কিছু বলিল না ! V রাজবৈদ্য আসিয়া সন্দেহ প্ৰকাশ করিয়া গেল। রাজা সন্ধ্যাবেলায় আবার হাসিকে দেখিতে আসিলেন । তখন বালিকা প্ৰলাপ বকিতেছে। বলিতেছে, “মাগো, এত রক্ত কেন ?” রাজা কহিলেন, “মা, এ রক্তস্রোত আমি নিবারণ করিব।” বালিকা বলিল, “আয় ভাই তাতা, আমরা দুজনে এ রক্ত মুছে ফেলি।” রাজা কহিলেন, “আয় মা, আমিও মুছি।” সন্ধ্যার কিছু পরেই হাসি একবার চােখ খুলিয়াছিল। একবার চারি দিকে চাহিয়া কাহাকে যেন যুজিল ; তখন তাতা অন্য ঘরে র্কাদিয়া কঁদিয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। কাহাকে যেন না দেখিতে পাইয়া S 1186