পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি ay a ফেলিয়াছি, অথচ সংশয় যাইতেছে না । আজ হইতে কেই-বা। আমার সংশয় ঘুচাইবে ! কোনটা ভালো কোনটা মন্দ আজ হইতে কে তাহা আমাকে বুঝাইয়া দিবে ! সংসারের সহস্ৰ কোটি পথের মোহানায় দাড়াইয়া কাহাকে জিজ্ঞাসা করিব কোনটা যথার্থ পথ । প্রান্তরের মধ্যে আমি অন্ধ একাকী দাড়াইয়া আছি, আজ আমার যষ্টি ভাঙিয়া গেছে ।” 象 জয়সিংহ যখন উঠিলেন তখন বৃষ্টি পড়িতে আরম্ভ করিয়াছে। বৃষ্টিতে ভিজিতে ভিজিতে মন্দিরের দিকে চলিলেন । দেখিলেন বিস্তর লোক কোলাহল করিতে করিতে মন্দিরের দিক হইতে দল বাধিয়া চলিয়া আসিতেছে । বুড়া বলিতেছে, “বাপ-পিতামহর কাল থেকে এই তো চলে আসছে জানি, আজ রাজার বুদ্ধি কি তাদের সকলকেই ছাড়িয়ে উঠল !” যুবা বলিতেছে, “এখন আর মন্দিরে আসতে ইচ্ছে করে না, পূজার সে ধুম নেই।” কেহ বলিল, “এ যেন নবাবের রাজত্ব হয়ে দাড়ালো ৷” তাহার মনের ভাব এই যে, বলিদান সম্বন্ধে দ্বিধা একজন মুসলমানের মনেই জন্মাইতে পারে, কিন্তু একজন হিন্দুর মনে জন্মানো অত্যন্ত আশ্চর্য । মেয়েরা বলিতে লাগিল, “এ রাজ্যের মঙ্গল হবে না ।” একজন কহিল, “পুরুত-ঠাকুর তো স্বয়ং বললেন যে, মা স্বপ্নে বলেছেন তিন মাসের মধ্যে এ দেশ মড়কে উচ্ছন্ন যাবে ।” হারু বলিল, “এই দেখে-না কেন, মোধো আজ দেড় বছর ধরে ব্যামো ভুগে বরাবর বেঁচে এসেছে যেই বলি বন্ধ হল অমনি সে মারা গেল ।” ক্ষান্ত বলিল, “তা কেন, আমার ভাশুরপো, সে যে মরবে। এ কে জানত ! তিন দিনের জ্বর । যেমনি কবিরাজের বড়িটি খাওয়া আমনি চোখ উলটে গেল।” ভাশুরপোর শোকে, এবং রাজ্যের অমঙ্গল-আশঙ্কায় ক্ষান্ত কাতর হইয়া পড়িল । তিনকড়ি কহিল, “সেদিন মথুরহাটির গঞ্জে আগুন লাগল, একখানা চালাও বাকি রইল না।” চিন্তামণি চাষা তাহার একজন সঙ্গী চাষাকে কহিল, “অত কথায় কাজ কী, দেখে-না কেন এ বছর যেমন ধান সস্তা হয়েছে এমন অন্য কোনো বছর হয় নি। এ বছর চাষার কপালে কী আছে কে ଔ( !” বলিদান বন্ধ হইবার পরে এবং পূর্বেও যাহার যাহা-কিছু ক্ষতি হইয়াছে, সর্বসম্মতিক্রমে ঐ বলি বন্ধ হওয়াই তাহার একমাত্র কারণ নির্দিষ্ট হইল। এ দেশ পরিত্যাগ করিয়া যাওয়াই ভালো, এইরূপ সুকুলর মত হইল। এ মত কিছুতেই পরিবর্তিত হইল না বটে, কিন্তু দেশেই সকলে বাস করতে 5ळल । জয়সিংহ অন্যমনস্ক ছিলেন । ইহাদের প্রতি কিছুমাত্ৰ মনোযোগ না করিয়া তিনি মন্দিরে গিয়া উপস্থিত হইলেন ; দেখিলেন, পূজা শেষ করিয়া রঘুপতি মন্দিরের বাহিরে বসিয়া আছেন। দ্রুতগতি রঘুপতির নিকটে গিয়াই জয়সিংহ কাতর অথচ দৃঢ় স্বরে তাহাকে জিজ্ঞাসা করিলেন, "গুরুদেব, মায়ের আদেশ গ্ৰহণ করিবার জন্য আজ প্রভাতে আমি যখন মাকে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিলাম, আপনি কেন তাহার উত্তর দিলেন ?” রঘুপতি একটু ইতস্তত করিয়া বলিলেন, “মা তাে আমার দ্বারাই তাহার আদেশ প্রচার করিয়া থাকেন, তিনি নিজমুখে কিছু বলেন না ।” জয়সিংহ কহিলেন, “আপনি সম্মুখে উপস্থিত হইয়া বলিলেন না কেন ? অন্তরালে লুক্কায়িত থাকিয়া আমাকে ছলনা করিলেন কেন ?” রঘুপতি ক্রুদ্ধ হইয়া বলিলেন, “চুপ করো। আমি কী ভাবিয়া কী করি তুমি তাহার কী বুঝিবে ? বাঁচালের মতো যাহা মুখে আসে তাঁহাই বলিয়াে না। আমি যাহা আদেশ করিব তুমি কেবল তাহাই পালন করিবে, কোনো প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করিয়ো না ।”