পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Q Sbr. রবীন্দ্র-রচনাবলী জয়সিংহ চুপ করিয়া রহিলেন । র্তাহার সংশয় বাড়িল বৈ কমিল না। কিছুক্ষণ পরে বলিলেন, “আজ প্ৰাতে আমি মায়ের কাছে বলিয়াছিলাম যে, তিনি যদি স্বমুখে আমাকে আদেশ না করেন তবে আমি কখনোই রাজহত্যা ঘটিতে দিব না, তাহার ব্যাঘাত করিব । যখন স্থির বুঝিলাম মা আদেশ করেন নাই, তখন মহারাজের নিকট নক্ষত্ররায়ের সংকল্প প্ৰকাশ করিয়া দিতে হইল, তাহাকে সতর্ক করিয়া দিলাম ।” রঘুপতি কিয়ৎক্ষণ চুপ করিয়া বসিয়া রহিলেন । উদবোেল ক্ৰোধ দমন করিয়া দৃঢ়স্বরে বলিলেন, উভয়ে মন্দিরে প্রবেশ করিলেন । , রঘুপতি কহিলন, “মায়ের চরণ স্পর্শ করিয়া শপথ করো--- বলে যে, ২৯শে আষাঢ়ের মধ্যে আমি রাজরক্ত আনিয়া এই চরণে উপহার দিব ।” জয়সিংহ ঘাড় হেঁট করিয়া কিছুক্ষণ চুপ করিয়া রহিলেন । পরে একবার গুরুর মুখের দিকে একবার প্রতিমার মুখের দিকে চাহিলেন । প্রতিমা স্পর্শ করিয়া ধীরে ধীরে বলিলেন, “২৯শে আষাঢ়ের মধ্যে আমি রাজরক্ত আনিয়া এই চরণে উপহার দিব ।” দশম পরিচ্ছেদ আচ্ছন্ন হইয়া গেছে । মেঘের ছায়ায় দিন আবার অন্ধকার হইয়া আসিয়াছে । মহারাজ অত্যন্ত বিমন। আছেন । অন্যদিন রাজসভায় নক্ষত্ররায় উপস্থিত থাকিতেন, আজ তিনি উপস্থিত ছিলেন না । রাজা তাহাকে ডাকিয়া পাঠাইলেন, তিনি ওজর করিয়া বলিয়া পাঠাইলেন তাহার শরীর অসুস্থ । রাজা স্বয়ঃ নক্ষত্ররায়ের কক্ষে গিয়া উপস্থিত হইলেন । নক্ষত্ৰ মুখ তুলিয়া রাজার মুখের দিকে চাহিতে পারিলেন না । একখানা লিখিত কাগজ লইয়া কাজে ব্যস্ত আছেন এমনি ভান করিলেন । রাজা বলিলেন, “নক্ষত্ৰ, তোমার কি অসুখ করিয়াছে ?” নক্ষত্ৰ কাগজের এপিঠ ওপিঠ উলটাইয়া হাতের অঙ্গুরি নিরীক্ষণ করিয়া বলিলেন, “অসুখ ? না, অসুখ ঠিক নয়— এই একটুখানি কাজ ছিল— হা হা, অসুখ হয়েছিল— কতকটা অসুখের মতন বটে ।” নক্ষত্ররায় নিতান্ত অধীর হইয়া উঠিলেন, গোবিন্দমাণিক্য অতিশয় বিষন্নমুখে নক্ষত্রের মুখের দিকে চাহিয়া রহিলেন । তিনি ভাবিতে লাগিলেন— ‘হায় হায়, মেহের নীড়ের মধ্যেও হিংসা ঢুকিয়াছে, সে সাপের মতো লুকাইতে চায়, মুখ দেখাইতে চায় না । আমাদের অরণ্যে কি হিংস্র পশু যথেষ্ট নাই, শেষে কি মানুষও মানুষকে ভয় করিবে, ভাইও ভাইয়ের পাশে গিয়া নিঃশঙ্কচিত্তে বসিতে পাইবে না ! এ সংসারে হিংসা-লোভই এত বড়ো হইয়া উঠিল, আর স্নেহ-প্ৰেম কোথাও ঠাই পাইল না ! এই আমার ভাই, ইহার সহিত প্রতিদিন এক গৃহে বাস করি, একাসনে বসিয়া থাকি, হাসিমুখে কথা কই-- এও আমার পাশে বসিয়া মনের মধ্যে ছুরি শানাইতেছে!’ গোবিন্দমাণিক্যের নিকট তখন সংসার হিংস্ৰজন্তু পূর্ণ অরণ্যের মতো বােধ হইতে লাগিল। ঘন অন্ধকারের মধ্যে কেবল চারি দিকে দন্ত ও নখরের ছটা দেখিতে পাইলেন । দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিয়া মহারাজ মনে করিলেন, “এই মেহপ্ৰেমহীন হানাহানির রাজ্যে বঁাচিয়া থাকিয়া আমি আমার স্বজাতির, আমার ভাইদের মনে কেবলই হিংসা লোভ ও দ্বেষের অনল জ্বালাইতেছি- আমার সিংহাসনের চারি দিকে আমার প্রাণাধিক আত্নীয়েরা আমার দিকে চাহিয়া মনে মনে মুখ বক্র করিতেছে, দন্ত ঘর্ষণ করিতেছে, শৃঙ্খলবদ্ধ ভীষণ কুকুরের মতো চাৰি দিক হইতে আমার উপরে ঝাপাইয়া পড়িবার অবসর খুঁজিতেছে। ইহা অপেক্ষা ইহাদের খরনখরাঘাতে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হইয়া, ইহাদের রক্তের তৃষা মিটাইয়া এখান হইতে অপসৃত হওয়াই ভালো ।” প্রভাত-আকাশে গোবিন্দমাণিক্য যে প্ৰেমমুখচ্ছবি দেখিয়াছিলেন তাহা কোথায় মিলাইয়া গেল ।