পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৫৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ ՀՀ রবীন্দ্র-রচনাবলী দ্বাদশ পরিচ্ছেদ তাহার পরদিন যখন জয়সিংহ মন্দিরে ফিরিয়া আসিলেন, তখন পূজার সময় অতীত হইয়া গিয়াছে। রঘুপতি বিমর্ষ মুখে একাকী বসিয়া আছেন । ইহার পূর্বে কখনো এরূপ অনিয়ম হয় নাই। জয়সিংহ আসিয়া গুরুর কাছে না গিয়া তাহার বাগানের মধ্যে গেলেন । তাহার গাছপালাগুলিৰ মধ্যে গিয়া বসিলেন । তাহারা তাহার চারি দিকে কঁাপিতে লাগিল, নড়িতে লাগিল, ছায়া নাচাইতে লাগিল। তাহার চারি দিকে পুষ্পখিচিত পল্লবের স্তর, শ্যামল স্তরের উপর স্তর, ছায়াপূর্ণ সুকোমল মেহের আচ্ছাদন, সুমধুর আহবান, প্রকৃতির গ্ৰীতিপূর্ণ আলিঙ্গন। এখানে সকলে অপেক্ষা করিয়া থাকে, কথা জিজ্ঞাসা করে না, ভাবনার ব্যাঘাত করে না, চাহিলে তবে চায়, কথা কহিলে তবে কথা কয় । এই নীরব শুশ্রুষার মধ্যে, প্রকৃতির এই অন্তঃপুরের মধ্যে বসিয়া জয়সিংহ ভাবিতে লাগিলেন । রাজা তাহাকে যে-সকল উপদেশ দিয়াছিলেন, তাহাই মনে মনে আলোচনা করিতে লাগিলেন : এমন সময়ে ধীরে ধীরে রঘুপতি আসিয়া তাহার পিঠে হাত দিলেন। জয়সিংহ সচকিত হইয়া উঠিলেন। রঘুপতি র্তাহার পাশে বসিলেন। জয়সিংহের মুখের দিকে চাহিয়া কম্পিতস্বরে কহিলেন, “বৎস, তোমার এমন ভাব দেখিতেছি কেন ? আমি তোমার কী করিয়াছি যে, তুমি অল্পে অল্পে আমার জয়সিংহ কী বলিতে চেষ্টা করিলেন, রঘুপতি তাহাতে বাধা দিয়া বলিতে লাগিলেন, “এক মুহূর্তের জন্য কি আমার মেহের অভাব দেখিয়াছ ? আমি কি তোমার কাছে কোনো অপরাধ করিয়াছি জয়সিংহ ? যদি করিয়া থাকি তবে আমি তোমার গুরু, তোমার পিতৃতুল্য, আমি তোমার কাছে ক্ষম ভিক্ষা চাহিতেছি- আমাকে মার্জনা করে ।” d জয়সিংহ বজোহতের ন্যায় চমকিয়া উঠিলেন ; গুরুর চরণ ধরিয়া কঁদিতে লাগিলেন ; বলিলেন, “পিতা, আমি কিছুই জানি না, আমি কিছুই বুঝিতে পারি না, আমি কোথায় যাইতেছি দেখিতে পাইতেছি না ।” রঘুপতি জয়সিংহের হাত ধরিয়া বলিলেন, “বৎস, আমি তোমাকে তোমার শৈশব হইতে মাতার ন্যায় স্নেহে পালন করিয়াছি, পিতার অধিক যত্নে শাস্ত্ৰশিক্ষা দিয়াছি— তোমার প্রতি সম্পূর্ণ বিশ্বাস স্থাপন করিয়া সখার ন্যায় তোমাকে আমার সমুদয় মন্ত্রণার সহযোগী করিয়াছি। আজ তোমাকে কে আমার পাশ হইতে টানিয়া লইতেছে ? এতদিনকার মেহমমতার বন্ধন কে বিচ্ছিন্ন করিতেছে % তোমার উপর আমার যে দেবদত্ত অধিকার জন্মিয়াছে সে পবিত্র অধিকারে কে হস্তক্ষেপ করিয়াছে % বলো, বৎস, সেই মহাপাতকীর নাম বলে ।” জয়সিংহ বলিলেন, “প্ৰভু, আপনার কাছ হইতে আমাকে কেহ বিচ্ছিন্ন করে নাই— আপনিই আমাকে দূর করিয়া দিয়াছেন। আমি ছিলাম গৃহের মধ্যে, আপনি সহসা পথের মধ্যে আমাকে বাহির করিয়া দিয়াছেন । আপনি বলিয়াছেন, কেই-বা পিতা, কেই-বা মাতা, কেই-বা ভ্ৰাতা । আপনি বলিয়াছেন, পৃথিবীতে কোনো বন্ধন নাই, মেহপ্রেমের পবিত্র অধিকার নাই। র্যাহাকে মা বলিয়া জানিতাম, আপনি তঁহাকে বলিয়াছেন শক্তি— যে যেখানে হিংসা করিতেছে, যে যেখানে রক্তপাত করিতেছে, যেখানেই ভাইয়ে ভাইয়ে বিবাদ, যেখানেই দুইজন মানুষে যুদ্ধ, সেইখানেই এই তৃষিত শক্তি রক্তলালসায় তাহার খর্পর লইয়া দাড়াইয়া আছেন । আপনি মায়ের কোল হইতে আমাকে এ কী রাক্ষসীর দেশে নির্বাসিত করিয়া দিয়াছেন ৷” রঘুপতি অনেকক্ষণ স্তম্ভিত হইয়া বসিয়া রহিলেন । অবশেষে নিশ্বাস ফেলিয়া বলিলেন, “তবে তুমি স্বাধীন হইলে, বন্ধনমুক্ত হইলে, তোমার উপর হইতে আমার সমস্ত অধিকার আমি প্রত্যাহরণ করিলাম। তাহাতেই যদি তুমি সুখী হও, তবে তাই হউক ৷” বলিয়া উঠিবার উদযোগ করিলেন। জয়সিংহ তাহার পা ধরিয়া বলিলেন, “না না না প্ৰভু— আপনি আমাকে ত্যাগ করিলেও আমি