পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬১

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ ՀS “ভ্ৰাতৃস্নেহ ! হাঃ হাঃ হাঃ ! ঠাকুর—” নক্ষত্ররায়ের হাসি আর বাহির হইল না, গলা শুকাইয়া গেল । রঘুপতি কহিলেন, “আমি গোবিন্দমাণিক্যের রক্ত চাই না। পৃথিবীতে গোবিন্দমাণিক্যের যে প্রাণের অপেক্ষা প্রিয়, আমি তাহাকেই চাই । তাহার রক্ত লইয়া আমি গোবিন্দমাণিক্যের গায়ে মাখাইতে চাই- তাহার বক্ষস্থল রক্তবর্ণ হইয়া যাইবে— সে রক্তের চিহ্ন কিছুতেই মুছিবে না। এই দেখোচাহিয়া দেখো ।” বলিয়া উত্তরীয় মোচন করিলেন, তাহার দেহ রক্তে লিপ্ত, তাহার বক্ষোদেশে স্থানে স্থানে রক্ত জমিয়া আছে। নক্ষত্ররায় শিহরিয়া উঠিলেন। তাহার হাত-পা কঁাপিতে লাগিল। রঘুপতি বজ্ৰমুষ্টিতে নক্ষত্ররায়ের হাত চাপিয়া ধরিয়া বলিলেন, “সে কে ? কে গোবিন্দমাণিক্যের প্রাণের অপেক্ষা প্রিয় ? কে চলিয়া গেলে গোবিন্দমাণিক্যের চক্ষে পৃথিবী শ্মশান হইয়া যাইবে, তাহার জীবনের উদ্দেশ্য চলিয়া যাইবে ? সকালে শয্যা হইতে উঠিয়াই কাহার মুখ তাহার মনে পড়ে, কাহার স্মৃতি সঙ্গে করিয়া তিনি রাত্ৰে শয়ন কুড়ে যান, গুহার হৃদরের নীড় সমস্তটা পরিপূর্ণ কৰিয়া কে বিরাজ করতেছে ? সে কে ? সে কি তুমি ?” বলিয়া, ব্যাঘ লম্ফ দিবার পূর্বে কম্পিত হরিণশিশুর দিকে যেমন একদৃষ্টিতে চায়, রঘুপতি তেমনি নক্ষত্রের দিকে চাহিলেন । নক্ষত্ররায় তাড়াতাড়ি বলিয়া উঠিলেন, “না, আমি না।” কিন্তু কিছুতেই রঘুপতির মুষ্টি ছাড়াইতে পারিলেন না। রঘুপতি বলিলেন, “তবে বলে সে কে ?” নক্ষত্ররায় বলিয়া ফেলিলেন, “সে ধ্রুব ।” রঘুপতি বলিলেন, “খুব কে ?” নক্ষত্ররায় । সে একটি শিশু রঘুপতি বলিলেন, “আমি জানি, তাহাকে জানি । রাজার নিজের সন্তান নাই, তাহাকেই সস্তানের মতো পালন করিতেছেন। নিজের সন্তানকে লোকে কেমন ভালোবাসে জানি না, কিন্তু পালিত সন্তানকে প্ৰাণের চেয়ে ভালোবাসে তাহা জানি । আপনার সমুদয় সম্পদের চেয়ে তাহার সুখ রাজার বেশি মনে হয় । আপনার মাথায় মুকুটের চেয়ে তাহার মাথায় মুকুট দেখিতে রাজার বেশি আনন্দ হয় ।” নক্ষত্ররায় আশ্চর্য হইয়া বলিয়া উঠিলেন, “ঠিক কথা ।” রঘুপতি কহিলেন, “ঠিক কথা নয় তাে কী ! রাজা তাহাকে কতখানি ভালোবাসেন তাহা কি আমি জানি না ! আমি কি বুঝিতে পারি না ! আমিও তাহাকেই চাই ।” নক্ষত্ররায় হাঁ করিয়া রঘুপতির দিকে চাহিয়া রহিলেন । আপন মনে বলিলেন, “তাহাকেই চাই ।” রঘুপতি কহিলেন, “তাহাকে আনিতেই হইবে— আজই আনিতে হইবে— আজ রাত্রেই চাই ।” নক্ষত্ররায়ের মুখের দিকে কিছুক্ষণ চাহিয়া গলার স্বর নামাইয়া রঘুপতি বলিলেন, “এই শিশুই তোমার শত্ৰু, তাহা জান ? তুমি রাজবংশে জন্মিয়াছ— কোথাকার এক অজ্ঞাতকুলশীল শিশু তােমার মাথা হইতে মুকুট কড়িয়া লইতে আসিয়াছে তাহা কি জান ? যে সিংহাসন তােমার জন্য অপেক্ষা করিতেছিল, সেই সিংহাসনে তাহার জন্য স্থান নির্দিষ্ট হইয়াছে তাহা কি দুটাে চক্ষু থাকিতে দেখিতে *ांशङछ ना !” h - নক্ষত্ররায়ের কাছে এ-সকল কথা নূতন নহে। তিনিও পূর্বে এইরূপ ভাবিয়াছিলেন। সগর্বে বলিলেন, “তা কি আর বলিতে হইবে ঠাকুর ! আমি কি আর এইটে দেখিতে পাই না ?” রঘুপতি কহিলেন, “তবে আর কী ! তবে তাহাকে আনিয়া দাও ! তােমার সিংহাসনের বাধা দূর করি। এই কটা প্রহর কোনােমতে কাটিবে, তার পর— তুমি কখন আনিবে ?”