পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি avy রাজা সত্বর উঠিয়া গিয়া চন্দ্রালোকে দেখিতে পাইলেন, ধ্রুবের পিতৃব্য কেদারেশ্বর । জিজ্ঞাসা করিলেন, “কী হইয়াছে ?” יין וף" কেদারেশ্বর বলিতে লাগিলেন, “অপরাহু হইতে ধ্রুবকে না দেখিতে পাওয়ায় জিজ্ঞাসা করাতে যুবরাজ নক্ষত্ররায়ের ভূত কহিল, ধ্রুব অন্তঃপুরে যুবরাজের কাছে আছে । শুনিয়া আমি নিশ্চিন্ত ছলাম। অনেক রাত হইতে দেখিয়া আমার আশঙ্কা জন্মিল ; অনুসন্ধান করিয়া জানিলাম, যুবরাজ নক্ষত্ররায় প্রাসাদে নাই । আমি মহারাজের সহিত সাক্ষাৎ-প্রার্থনার জন্য অনেক চেষ্টা করিয়াছিলাম, কিন্তু প্রহরীরা কিছুতেই আমার কথা গ্রাহা করিল না- এইজন্য বাতায়নের নীচে হইতে মহারাজকে ডাকিয়াছি, আপনার নিদ্রাভঙ্গ করিয়াছি, আমার এই অপরাধ মার্জনা করিবেন।” রাজার মনে একটা ভাব বিদ্যুতের মতো চমকিয়া উঠিল । তিনি চারিজন প্রহরীকে ডাকিলেন, কহিলেন, “সশস্ত্রে আমার অনুসরণ করো ।” একজন কহিল, “মহারাজ, আজ রাত্রে পথে বাহির হওয়া নিযেধ ।” রাজা কহিলেন, “আমি আদেশ করিতেছি ।” কেদারেশ্বর সঙ্গে যাইতে উদ্যত হইলেন, রাজা তাহাকে ফিরিয়া যাইতে কহিলেন । বিজন পথে চন্দ্ৰলোকে রাজা মন্দিরাভিমুখে চলিলেন । মন্দিরের দ্বার যখন সহসা খুলিয়া গেল, দেখা গেল খড়গ সম্মুখে করিয়া নক্ষত্র এবং রঘুপতি মদ্যপান করিতেছেন । আলোক অধিক নাই, একটি দীপ জ্বলিতেছে । ধ্রুব কোথায় ? ধ্রুব কালীপ্রতিমার পায়ের কাছে শুইয়া ঘুমাইয়া পড়িয়াছে— তাহার কপোলের অশ্রুরেখা শুকাইয়া গেছে, ঠোঁট দুটি একটু খুলিয়া গেছে, মুখে ভয় নাই, ভাবনা নাই- এ যেন পাষাণ-শয্যা নয়, যেন সে দিদির কোলের উপরে শুইয়া আছে। দিদি যেন চুমো খাইয়া তাহার চোখের জল মুছাইয়া দিয়াছে। মদ খাইয়া নক্ষত্রের প্রাণ খুলিয়া গিয়াছিল, কিন্তু রঘুপতি স্থির হইয়া বসিয়া পূজার লগ্নের জন্য অপেক্ষা করিতেছিলেন— নক্ষত্রের প্রলাপে কিছুমাত্ৰ কান দিতেছিলেন না । নক্ষত্ৰ বলিতেছিলেন, "ঠাকুর, তোমার মনে মনে ভয় হচ্ছে। তুমি মনে করছ আমিও ভয় করছি। কিছু ভয় নেই। ঠাকুর ! ভয় কিসের !! ভয় কাকে ! আমি তোমাকে রক্ষা করব । তুমি কি মনে কর আমি রাজাকে ভয় করি ! আমি শাসুজাকে ভয় করি নে, আমি শাজাহানকে ভয় করি নে। ঠাকুর, তুমি বললে না কেন— আমি রাজাকে ধরে আনতুম, দেবীকে সন্তুষ্ট করে দেওয়া যেত। ঐটুকু ছেলের কতটুকুই বা রক্ত !” এমন সময় সহসা মন্দিরের ভিত্তির উপরে ছায়া পড়িল ৷ নক্ষত্ররায় পশ্চাতে চাহিয়া দেখিলেন—— রাজা । চকিতের মধ্যে নেশা সম্পূর্ণ ছুটিয়া গেল। নিজের ছায়ার চেয়ে নিজে মলিন হইয়া গেলেন । দ্রুতবেগে নিদ্রিত ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া লইয়া গােবিন্দমাণিক্য প্রহরীদিগকে কহিলেন, “ইহাদের দুজনকে বন্দী করো ।” চারিজন প্রহরী রঘুপতি ও নক্ষত্ররায়ের দুই হাত ধরিল। ধ্রুবকে বুকের মধ্যে চাপিয়া ধরিয়া বিজন পথে জ্যোৎস্নালোকে রাজা প্রাসাদে ফিরিয়া আসিলেন । রঘুপতি ও নক্ষত্ররায় সে রাত্রে কারাগারে রহিলেন । অষ্টাদশ পরিচ্ছেদ তাহার পরদিন বিচার । বিচারশালা লোকে লোকারণ্য। বিচারাসনে রাজা বসিয়াছেন, সভাসদেরা টারি দিকে বসিয়াছেন। সম্মুখে দুইজন বন্দী। কাহারও হাতে শৃঙ্খল নাই। কেবল সশস্ত্র প্রহরী তাহাদিগকে ঘেরিয়া আছে— রঘুপতি পাষাণমূর্তির মতো দাড়াইয়া আছেন, নক্ষত্ররায়ের মাথা নত।