পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি °i\9\9 যড়যন্ত্র করিয়া বলির মানসে একটি শিশুকে হরণ করিয়াছিলেন । এই অপরাধ। সপ্ৰমাণ হওয়াতে আমি র্তাহার আট বৎসর নির্বাসনদণ্ড বিধান করিলাম।” প্রহরীরা যখন নক্ষত্ররায়কে লইয়া যাইতে উদ্যত হইল। তখন রাজা আসন হইতে নামিয়া নক্ষত্ররায়কে আলিঙ্গন করিলেন ; রুদ্ধকণ্ঠে কহিলেন, “বৎস, কেবল তোমার দণ্ড হইল না, আমারও দণ্ড হইল। না জানি পূর্বজন্মে কী অপরাধ করিয়াছিলাম ! যতদিন তুমি বন্ধুদের কােছ হইতে দূরে থাকিবে দেবতা তোমার সঙ্গে সঙ্গে থাকুন, তোমার মঙ্গল করুন।” সংবাদ দেখিতে দেখিতে রাষ্ট্র হইল। অন্তঃপুরে ক্ৰন্দনধ্বনি উঠিল। রাজা নিভৃত কক্ষে দ্বার রুদ্ধ করিয়া বসিয়া পড়িলেন। জোড়হাতে কহিতে লাগিলেন, “প্ৰভু, আমি যদি কখনাে অপরাধ করি, আমাকে মার্জনা করিয়ো না, আমাকে কিছুমাত্র দয়া করিয়ো না । আমাকে আমার পাপের শাস্তি দাও । পাপ করিয়া শাস্তি বহন করা যায়, কিন্তু মার্জনাভার বহন করা যায় না প্ৰভু !” নক্ষত্ররায়ের প্রেম রাজার মনে দ্বিগুণ জাগিতে লাগিল। নক্ষত্ররায়ের ছেলেবেলাকার মুখ তাহার মনে পড়িতে লাগিল । সে যে-সকল খেলা করিয়াছে, কথা কহিয়াছে, কাজ করিয়াছে, তাহা একে একে র্তাহার মনে উঠিতে লাগিল। এক-একটা দিন, এক-একটা রাত্রি তাহার সূর্যালোকের মধ্যে, তাহার তারাখচিত আকাশের মধ্যে শিশু নক্ষত্ররায়কে লইয়া তাহার সম্মুখে উদয় হইল। রাজার দুই চক্ষু দিয়া জল পড়িতে লাগিল । উনবিংশ পরিচ্ছেদ নির্বাসনোদ্যত রঘুপতিকে যখন প্রহরীরা জিজ্ঞাসা করিল “ঠাকুর, কোন দিকে যাইবেন।” তখন রঘুপতি উত্তর করিলেন, “পশ্চিম দিকে যাইব ।” নয় দিন পশ্চিম মুখে যাত্রার পর বন্দী ও প্রহরীরা ঢাকা শহরের কাছাকাছি আসিয়া পৌঁছিল। তখন প্রহরীরা রঘুপতিকে ছাড়িয়া রাজধানীতে ফিরিয়া আসিল । রঘুপতি মনে মনে বলিলেন, ‘কলিতে ব্ৰহ্মশাপ ফলে না, দেখা যাক ব্ৰাহ্মণের বুদ্ধিতে কতটা হয় । দেখা যাক, গােবিন্দমাণিক্যই বা কেমন রাজা, আর আমিই বা কেমন পুরোহিত-ঠাকুর ' ত্রিপুরার প্রান্তে মন্দিরের কোণে মোগল-রাজ্যের সংবাদ বড়ো পৌঁছিত না । এই নিমিত্ত রঘুপতি ঢাকা শহরে গিয়া মোগলদিগের রীতিনীতি ও রাজ্যের অবস্থা জানিতে কৌতুহলী হইলেন । তখন মোগলসম্রাট শাজাহানের রাজত্বকাল । তখন তাহার তৃতীয় পুত্র ঔরংজীব। দক্ষিণাপথে বিজাপুর-আক্রমণে নিযুক্ত ছিলেন। র্তাহার দ্বিতীয় পুত্র সুজা বাংলার অধিপতি ছিলেন, রাজমহলে তাহার রাজধানী। কনিষ্ঠ পুত্ৰ কুমার মুরাদ গুজরাটের শাসনকর্তা। জ্যেষ্ঠ যুবরাজ দারা রাজধানী দিল্লিতেই বাস করিতেছেন। সম্রাটের বয়স ৬৭ বৎসর। র্তাহার শরীর অসুস্থ বলিয়া দারার উপরেই সাম্রাজ্যের ভার পড়িয়াছে। রঘুপতি কিয়ৎকাল ঢাকায় বাস করিয়া উর্দুভাষা শিক্ষা করিলেন ও অবশেষে রাজমহল অভিমুখে যাত্রা করিলেন । রাজমহলে যখন পৌঁছিলেন, তখন ভারতবর্ষে হুলস্থূল পড়িয়া গিয়াছে। সংবাদ রাষ্ট্র হইয়াছে যে, শাজাহান মৃত্যুশয্যায় শয়ন । এই সংবাদ পাইবামাত্র সুজা সৈন্যসহিত দিল্লি-অভিমুখে ধাবমান হইয়াছেন। সম্রাটের চারি পুত্ৰই মুমূর্য শাজাহানের মাথার উপর হইতে মুকুটাটা একেবারে ছো মারিয়া উড়াইয়া লইবার উদযোগ করিতেছেন ! ব্ৰাহ্মণ তৎক্ষণাৎ অরাজক রাজমহল ত্যাগ করিয়া সুজার অনুসরণে প্ৰবৃত্ত হইলেন । লোকজন বাহিক প্রভৃতিকে বিদায় করিয়া দিলেন। সঙ্গে যে দুই লক্ষ টাকা ছিল তাহারাজমহলের নিকটবতী এক বিজন প্রান্তরে পুঁতিয়া ফেলিলেন। তাহার উপরে এক চিহ্ন রাখিয়া গেলেন। অতি অল্প টাকাই সঙ্গে পাইলেন । দগ্ধ কুটির, পরিত্যক্ত গ্রাম, মন্দিত শস্যক্ষেত্র লক্ষ্য করিয়া রঘুপতি অবিশ্রাম অগ্রসর হইতে ।