পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ANO 8 রবীন্দ্র-রচনাবলী লাগিলেন। রঘুপতি সন্ন্যাসীর বেশ ধারণ করিলেন ; কিন্তু সন্ন্যাসীর বেশ সত্ত্বেও আতিথ্য পাওয় দুর্ঘট । কারণ, পঙ্গপালের ন্যায় সৈন্যেরা যে পথ দিয়া চলিয়া গিয়াছে, তাহার উভয় পার্শ্বে কেবল দুৰ্ভিক্ষ বিরাজ করিতেছে । সৈন্যেরা অশ্ব ও হস্তী পালের জন্য অপক শস্য কাটিয়া লইয়া গিয়াছে। কৃষকের মরাইয়ে একটি কণা অবশিষ্ট নাই। চারি দিকে কেবল লুণ্ঠনাবশিষ্ট বিশৃঙ্খলা ৷ অধিকাংশ লোক গ্রাম ছাড়িয়া পালাইয়াছে । দৈবাৎ যে দু-একজনকে দেখা যায় তাহাদের মুখে হাস্য নাই তাহারা চিকিত হরিণের ন্যায় সতর্ক । কাহাকেও তাহারা বিশ্বাস করে না, দয়া করে না । বিজন পথের তাহারা সমস্ত দিন অপেক্ষা করিয়া আছে। ধূমকেতুর পশ্চাদবর্তী উল্কােরাশির ন্যায় দস্যরা সৈনিকদের অনুসরণ করিয়া লুণ্ঠনাবশেষ লুঠিয়া লইয়া যায়। এমন-কি, মৃতদেহের উপর শৃগাল-কুকুরের নাম মাঝে মাঝে সৈন্যদল ও দস্যদলে। লড়াই বাধিয়া যায়। নিষ্ঠুরতা সৈন্যদের খেলা হইয়াছে, পার্শ্ববর্তী নিরীহ পথিকের পেটে খপ করিয়া একটা তলোয়ারের খোচা বসাইয়া দেওয়া বা তাহার মুণ্ড হইতে পাগড়ি-সমেত খানিকটা খুলি উড়াইয়া দেওয়া তাহারা সামান্য উপহাসমাত্ৰ মনে করে । গ্রামের লোকেরা তাহাদের দেখিয়া ভয় পাইতেছে দেখিলে তাঁহাদের পরম কৌতুক বোধ হয় । লুণ্ঠনাবশেষে তাহারা গ্রামের লোকদের উৎপীড়ন করিয়া আনন্দ উপভোগ করে । দুইজন মান্য ব্রাহ্মণকে পিঠে পিyে সংলগ্ন করিয়া টিকিতে টিকিতে র্বাধিয়া উভয়ের নাকে নস্য প্রয়োগ করে । দুই ঘোড়ার পিঠে একজন মানুষকে চড়াইয়া ঘোড়াদুটাকে চাবুক মারে ; দুই ঘোড়া দুই বিপরীত দিকে ছুটিয়া যায়, মাঝখানে মানুষটা পড়িয়া গিয়া হাত-পা ভাঙে। এইরূপ প্রতিদিন নূতন নূতন খেলা তাহারা আবিষ্কার করে । অকারণে গ্রাম জ্বালাইয়া দিয়া যায়। বলে যে, বাদশাহের সম্মানার্থ বাজি পুড়াইতেছে । সৈন্যদের পথে এইরূপ অত্যাচারের শত শত চিহ্ন পড়িয়া আছে। এখানে রঘুপতি আতিথ্য পাইবেন কোথায় ! কোনোদিন অনাহারে কোনোদিন অল্পাহারে কাটিতে লাগিল । রাত্রে অন্ধকারে এক ভগ্ন পরিতক্তি কুটিরে শ্রান্তদেহে শয়ন করিয়াছিলেন, সকালে উঠিয়া দেখেন এক ছিন্নশির মৃতদেহকে সমস্ত রান্ত্রি বালিশ করিয়া শুইয়াছিলেন। একদিন মধ্যাহ্নে রঘুপতি ক্ষুধিত হইয়া কোনো কুটিরে গিয়া দেখিলেন, একজন লোক তাহার ভাঙা সিন্দুকের উপরে হুমড়ি খাইয়া পড়িয়া আছে— বোধ হয় তাহার লুষ্ঠিত ধনের জন্য শোক করিতেছিল— কাছে গিয়া ঠেলিতেই সে গড়াইয়া পড়িয়া গেল। মৃতদেহ মাত্র, তাহার জীবন অনেক কাল হইল চলিয়া গিয়াছে। একদিন রঘুপতি এক কুটিরে শুইয়া আছেন । রাত্রি অবসান হয় নাই, কিছু বিলম্ব আছে। এমন সময় ধীরে ধীরে দ্বার খুলিয়া গেল। শরতের চন্দ্রালোকের সঙ্গে সঙ্গে কতকগুলি ছায়া ঘরের মধ্যে আসিয়া পড়িল । ফিস ফিস শব্দ শুনা গেল। রঘুপতি চমকিয়া উঠিয়া বসিলেন । তিনি উঠিতেই কতকগুলি স্ত্রীকণ্ঠ সভয়ে বলিয়া উঠিল, “ও মা গো !” একজন পুরুষ অগ্রসর হইয় বলিল, “কোন হ্যায় রে ?” রঘুপতি কহিলেন, “আমি ব্ৰাহ্মণ, পথিক । তোমরা কে ?” “আমাদের এই ঘর । আমরা ঘর ছাড়িয়া পালাইয়াছিলাম । মোগল সৈন্য চলিয়া গিয়াছে শুনিয়া তবে এখানে আসিয়াছি।” রঘুপতি জিজ্ঞাসা করিলেন, “মোগল সৈন্য কোন দিকে গিয়াছে ?” তাহারা কহিল, “বিজয়গড়ের দিকে । এতক্ষণ বিজয়গড়ের বনের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে।" রঘুপতি আর অধিক কিছু না বলিয়া তৎক্ষণাৎ যাত্ৰা করিলেন ।