পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ Տ)@ বিংশ পরিচ্ছেদ বিজয়গড়ের দীর্ঘ বন ঠগীদের আড্ডা। বনের মধ্যে দিয়া যে পথ গিয়াছে সেই পথের দুই পার্থে কত মনুষ্যকঙ্কাল নিহিত আছে, তাহাদের উপরে কেবল বনফুল ফুটিতেছে, আর-কোনাে চিহ্ন নাই । বনের মধ্যে বট আছে, বাবলা আছে, নিম আছে, শত শত প্রকারের লতা ও গুল্ম আছে। স্থানে স্থানে ডোবা অথবা পুকুরের মতো দেখা যায়। অবিশ্রাম পাতা পচিয়া পচিয়া তাহার জল একেবারে সবুজ হইয়া উঠিয়াছে। ছোটাে ছোটাে সুড়ি পথ এ দিকে ও দিকে আঁকিয়া বাকিয়া সাপের মতো অন্ধকার জঙ্গলের মধ্যে প্রবেশ করিয়াছে। গাছের ডালে ডালে পালে পালে হনুমান । বটগাছের ডালের উপর হইতে শত শত শিকড় এবং হনুমানের লেজ বুলিতেছে। ভাঙা মন্দিরের প্রাঙ্গণে শিউলি ফুলের গাছ সাদা সাদা ফুলে এবং হনুমানের দন্তবিকাশে একেবারে আচ্ছন্ন। সন্ধ্যাবেলায় বড়ো বড়ো ঝাকড়া গাছের উপরে বঁাকে ঝাকে টিয়াপাখির চীৎকারে বনের ঘোর অন্ধকার যেন দীর্ণ বিদীর্ণ হইতে থাকে ! আজ এই বৃহৎ বনের মধ্যে প্ৰায় কুড়ি হাজার সৈন্য প্রবেশ করিয়াছে । এই ডালে-পালায় লতায়-পাতায় তৃণে-গুলো জড়িত বৃহৎ গোলাকার অরণ্য, কুড়ি হাজার খরনখচঞ্চ সৈনিক-বাজপক্ষীদের একটিমাত্র নীড় বলিয়া বোধ হইতেছে । সৈন্যসমাগম দেখিয়া অসংখ্য কাক কা কা করিয়া দল বাধিয়া আকাশে উড়িয়া বেড়াইতেছে- সাহস করিয়া ডালের উপর আসিয়া বসিতেছে না । কোনোপ্রকার গোলমাল করিতে সেনাপতির নিষেধ আছে । সৈন্যেরা সমস্ত দিন চলিয়া সন্ধ্যাবেলায় বনে আসিয়া শুষ্ক কাঠ কুড়াইয়া রন্ধন করিতেছে ও পরস্পর চুপি চুপি কথা কহিতেছেতাহাদের সেই গুন গুন শব্দে সমস্ত অরণ্য গম গম করিতেছে, সন্ধ্যাবেলার ঝিঝি পোকার ডাক শোনা যাইতেছে না । গাছের গুড়িতে বাধা অশ্বের মাঝে মাঝে খুর দিয়া মাটি খুঁড়িতেছে ও হেষাধবনি করিয়া উঠিতেছে- সমস্ত বনের তাহাতে চমক লাগিতেছে । ভাঙা মন্দিরের কাছে ফাকা জায়গায় শাসুজার শিবির পড়িয়াছে। আর সকলের আজ বৃক্ষতলেই অবস্থান । সমস্ত দিন অবিশ্রাম চলিয়া, রঘুপতি যখন বনের মধ্যে প্রবেশ করিলেন তখন রাত্রি হইয়াছে। অধিকাংশ সৈন্য নিস্তব্ধে ঘুমাইতেছে, অল্পমাত্র সৈন্য নীরবে পাহারা দিতেছে। মাঝে মাঝে এক-এক জায়গায় আগুন জ্বলিতেছে- অন্ধকার যেন বহু কষ্টে নিদ্রাক্রান্ত রাঙা চক্ষু মেলিয়াছে । রঘুপতি বনের মধ্যে পা দিয়াই কুড়ি হাজার সৈনিকের নিশ্বাস-প্ৰশ্বাস যেন শুনিতে পাইলেন । বনের সহস্র গাছ শাখা বিস্তার করিয়া পাহারা দিতেছে। কালপেচক তাহার সদ্যোজাত শাবকের উপর যেমন পক্ষ প্রসারিত করিয়া বসিয়া থাকে, তেমনি অরণ্যের বাহিরকার বিরাট রাত্রি অরণ্যের ভিতরকার গাঢ়তর রাত্রির উপর চাপিয়া ডানা ঝাপিয়া নীরবে বসিয়া আছে— অরণ্যের ভিতরে এক রাত্রি মুখ গুজিয়া ঘুমাইয়া আছে, অরণ্যের বাহিরে এক রাত্রি মাথা তুলিয়া জাগিয়া আছে। রঘুপতি সে রাত্রে বনপ্রান্তে শুইয়া রহিলেন । সকালে গােটা দুই-চার খোচা খাইয়া ধড়ফড় করিয়া জাগিয়া উঠিলেন। দেখিলেন জন-কত পাগড়ি-বাঁধা দাড়ি-পরিপূর্ণ তুরানি সৈন্য বিদেশী ভাষায় তাহাকে কী বলিতেছে ; শুনিয়া তিনি নিশ্চয় অনুমান করিয়া লইলেন- গালি । তিনিও বঙ্গ ভাষায় তাহাদের শ্যালক-সম্বন্ধ প্রচার করিয়া দিলেন । তাহারা তাহাকে টানাটানি করিতে লাগিল । রঘুপতি বলিলেন, “ঠাট্টা পেয়েছিস ?” কিন্তু তাঁহাদের আচরণে ঠাট্টার লক্ষণ কিছুমাত্র প্রকাশ পাইল না । বনের মধ্য দিয়া তাহারা তঁহাকে অকাতরে টানিয়া লইয়া যাইতে লাগিল । তিনি সবিশেষ অসন্তোষ প্রকাশ করিয়া বলিলেন, “টানাটানি কর কেন ? আমি আপনিই যাচ্ছি। এত পথ আমি এলুম কী করতে ?” সৈন্যেরা হাসিতে লাগিল ও র্তাহার বাংলা কথা নকল করিতে লাগিল। ক্রমে ক্রমে র্তাহার চতুর্দিকে বিস্তর সৈন্য জড়ো হইল, তাহাকে লইয়া ভারি গােল পড়িয়া গেল। উৎপীড়নেরও সীমা রহিল না। একজন সৈন্য একটা কাঠবিড়ালির লেজ ধরিয়া তঁহার মুণ্ডিত মাথায় ছাড়িয়া দিল— দেখিবার ইচ্ছা, ফল মনে করিয়া খায় কি না । একজন সৈন্য র্তাহার নাকের সম্মুখে একটা মোটা বেত বাকাইয়া ধরিয়া