পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৭২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ8O রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী রাজার ছেলেই হউক আর বাদশাহের ছেলেই হউক বাজারে দুখানার বেশি হাত খুঁজিয়া পাওয়া যায় না। বাধিয়া সুখ নাই।” P সুচেতসিংহ হাসিয়া নিজের হাতের দিকে চাহিয়া কহিলেন, “এই দুইখানা হাতই যথেষ্ট।” খুড়াসাহেব কিঞ্চিৎ ভাবিয়া বলিলেন, “তা বটে, সেকালে কাজ ছিল ঢের বেশি। আজকাল কাজ এত কম পড়িয়াছে যে, এই দুইখানা হাতেরই কোনো কৈফিয়ত দেওয়া যায় না। আরো হাত থাকিলে আরো গোফে তা দিতে হইত ।” আজ খুড়াসাহেবের বেশভুষার ত্রুটি ছিল না। চিবুকের নীচে হইতে পাকা দাড়ি দুই ভাগে বিভক্ত করিয়া তাহার দুই কানে লটকাইয়া দিয়াছেন। গোফজোড়া পাকাইয়া কৰ্ণরন্ধের কাছাকাছি লইয়া গিয়াছেন। মাথায় বঁকা পাগড়ি, কটিদেশে বঁকা তলোয়ার। জরির জুতার সম্মুখভাগ শিঙের মতো বাকিয়া পাকাইয়া উঠিয়াছে। আজ খুড়াসাহেবের চলিবার এমনি ভঙ্গি, যেন বিজয়গড়ের মহিমা র্তাহারই সর্বাঙ্গে তরঙ্গিত হইতেছে । আজ এই সমস্ত সমজদার লোকের নিকটে বিজয়গড়ের মাহাত্মা প্ৰমাণ হইয়া যাইবে এই আনন্দে তাহার আহারনিদ্ৰা নাই । সুচেতসিংহকে লইয়া প্ৰায় সমস্ত দিন দুর্গ পর্যবেক্ষণ করিলেন । সুচেতসিংহ যেখানে কোনোপ্রকার আশ্চর্য প্রকাশ না করেন সেখানে খুড়াসাহেব স্বয়ং “বাঁহবা বাহবা” করিয়া নিজের উৎসাহ রাজপুত বীরের হৃদয়ে সঞ্চারিত করিতে চেষ্টা করেন । বিশেষত দুর্গপ্রাকারের গাথুনি সম্বন্ধে তাহাকে সবিশেষ পরিশ্রম করিতে হইল। দুর্গপ্রাকার যেরূপ অবিচলিত, সুচেতসিংহও ততোধিক- তাহার মুখে কোনোপ্রকারই ভােব প্রকাশ পাইল না। খুড়াসাহেব ঘুরিয়া ফিরিয়া তঁহাকে একবার দুর্গপ্রাকারের বামে একবার দক্ষিণে, একবার উপরে একবার নীচে আনিয়া উপস্থিত করিতে লাগিলেন— বার বার বলিতে লাগিলেন, “কী তারিফ !” কিন্তু কিছুতেই সুচেতসিংহের হৃদয়দুর্গ অধিকার করিতে পারিলেন না। অবশেষে সন্ধ্যাবেলায় শ্ৰান্ত হইয়া সুচেতসিংহ বলিয়া উঠিলেন, “আমি ভরতপুরের গড় দেখিয়াছি, আর-কোনো গড় আমার চক্ষে লাগে না ।” খুড়াসাহেব কাহারও সঙ্গে কখনো বিবাদ করেন না ; নিতান্ত স্নান হইয়া বলিলেন, “অবশ্য অবশ্য । এ কথা বলিতে পারো বটে ।” নিশ্বাস ফেলিয়া দুৰ্গ সম্বন্ধে আলোচনা পরিত্যাগ করিলেন । বিক্রমসিংহের পূর্বপুরুষ দুর্গসিংহের কথা উঠাইলেন । তিনি বলিলেন, “দুৰ্গসিংহের তিন পুত্র ছিল। কনিষ্ঠ পুত্ৰ চিত্রসিংহের এক আশ্চর্য অভ্যাস ছিল । তিনি প্রতিদিন প্রাতে আধ সেরা আন্দাজ ছোলা দুধে সিদ্ধ করিয়া খাইতেন । র্তাহার শরীরও তেমনি ছিল। আচ্ছা জি, তুমি যে ভরতপুরের গড়ের কথা বলিতেছ, সে অবশ্য খুব মস্ত গড়ই হইবে- কিন্তু কই ব্ৰহ্মবৈবর্তপুরাণে তো তাহার কোনো উল্লেখ নাই।” সুচেতসিংহ হাসিয়া কহিলেন, “তাহার জন্য কাজের কোনো ব্যাঘাত হইতেছে না।” খুড়াসাহেব কাষ্ঠহাসি হাসিয়া কহিলেন, “হা হা হা ! তা ঠিক, তা ঠিক ! তবে কি জানো, ত্রিপুরার গড়ও বড়ো কম নহে, কিন্তু বিজয়গড়ের-” সুচেতসিংহ। ত্রিপুরা আবার কোন মুলুকে ? খুড়াসাহেব । সে ভারী মুলুক। অত কথায় কাজ কী, সেখানকার রাজপুরোহিত-ঠাকুর আমাদের গড়ে অতিথি আছেন, তুমি তাহার মুখে সমস্ত শুনিবে । কিন্তু ব্ৰাহ্মণকে আজ কোথাও খুঁজিয়া পাওয়া গেল না। খুড়াসাহেবের প্রাণ সেই ব্ৰাহ্মণের জন্য কঁদিতে লাগিল। তিনি মনে মনে কহিতে লাগিলেন, “এই রাজপুত গ্ৰাম্যগুলোর চেয়ে সে ব্রাহ্মণ অনেক ভালো।” সুচেতসিংহের নিকটে শতমুখে রঘুপতির প্রশংসা করিতে লাগিলেন এবং বিজয়গড় সম্বন্ধে রঘুপতির কী মত তাহাও ব্যক্ত করিলেন ।