পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ 8Եr রবীন্দ্র-রচনাবলী রঘুপতি বলেন, “এখন তোমাকে মরিতে দিবে কে ?” নক্ষত্ররায়ের মনে হইল, রঘুপতি অবকাশ না দিলে তাহার মরিবারও সুযোগ নাই। একজন স্ত্রীলোক নক্ষত্ররায়কে দেখিয়া বলিয়াছিল, ‘আহা, কাদের ছেলে গো ! একে পথে কে বাহিৰ করিয়াছে!’ শুনিয়া নক্ষত্ররায়ের প্রাণ গালিয়া গেল, তাহার চোখে জল আসিল, তাহার ইচ্ছা করিল। সেই স্ত্রীলোকটিকে মা বলিয়া তাহার সঙ্গে তাহার ঘরে চলিয়া যান । কিন্তু নক্ষত্ররায় রঘুপতির হাতে যতই কষ্ট পাইতে লাগিলেন রঘুপতির ততই বিশ হইতে লাগিলেন, রঘুপতির অঙ্গুলির ইঙ্গিতে তাহার সমস্ত অস্তিত্ব পরিচালিত হইতে লাগিল । চলিতে চলিতে ক্ৰমে নদীর বাহুল্য কমিয়া আসিতে লাগিল। ক্রমে ভূমি দৃঢ় হইয়া আসিল ; মৃত্তিকা লোহিত বর্ণ, কঙ্করময়, লোকালয় দূরে দূরে স্থাপিত, গাছপালা বিরল ; নারিকেল-বনের দেশ ছাড়িয়া দুই পথিক তাল-বনের দেশে আসিয়া পড়িলেন। মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো বাঁধ, শুষ্ক নদীর পথ, দূরে মেঘের মতো পাহাড় দেখা যাইতেছে। ক্ৰমে শাসুজার রাজধানী রাজমহল নিকটবতী হইতে লাগিল । অষ্টাবিংশ পরিচ্ছেদ অবশেষে রাজধানীতে আসিয়া উপস্থিত হইলেন। পরাজয় ও পলায়নের পরে সুজা নূতন সৈন্য-সংগ্রহের চেষ্টায় প্রবৃত্ত হইয়াছেন । কিন্তু রাজকোষে অধিক অর্থ নাই। প্ৰজাগণ করভারে “পীড়িত । ইতিমধ্যে দারাকে পরাজিত ও নিহত করিয়া ঔরংজেব দিল্লির সিংহাসনে বসিয়াছেন । সুজা এই সংবাদ পাইয়া অত্যন্ত বিচলিত হইলেন । কিন্তু সৈন্যসামন্ত কিছুই প্ৰস্তুত ছিল না, এইজন্য কিছু সময় হাতে পাইবার আশায় তিনি ছল করিয়া ঔরংজেবের নিকট এক দূত পঠাইয়া দিলেন। বলিয়া পাঠাইলেন যে, নয়নের-জ্যোতি হৃদয়ের-আনন্দ পরামমোহাস্পদ প্ৰিয়তম ভ্ৰাতা ঔরংজেব সিংহাসন-লাভে কৃতকার্য হইয়াছেন ইহাতে সুজা মৃতদেহে প্ৰাণ পাইলেন— এক্ষণে সুজার বাংলা-শাসন-ভার নূতন সম্রাট মঞ্জর করিলেই আনন্দের আর কিছু অবশিষ্ট থাকে না। ঔরংজেব অত্যন্ত সমাদরের সহিত দূতকে আহবান করিলেন । সুজার শরীর-মনের স্বাস্থ্য এবং সুজার পরিবারের মঙ্গল-সংবাদ জানিবার জন্য সবিশেষ ঔৎসুক্য প্রকাশ করিলেন এবং বলিলেন, “যখন স্বয়ং সম্রাট শাজাহান সুজাকে বাংলার শাসনকার্যে নিয়ােগ করিয়াছেন, তখন আর দ্বিতীয় মঞ্জুরি-পত্রের কোনো আবশ্যক নাই।' এই সময় রঘুপতি সুজার সভায় গিয়া উপস্থিত হইলেন । সুড়া কৃতজ্ঞতা ও সমাদরের সহিত ঠাহার উদ্ধারকর্ডকে আহ্বান করলেন। বললেন, “খ” p' রঘুপতি বলিলেন, “বাদশাহের কাছে কিছু নিবেদন আছে।” সুজা মনে মনে ভাবিলেন, ‘নিবেদন আবার কিসের ? কিছু অর্থ চাহিয়া না বসিলে বাচি । রঘুপতি কহিলেন, “আমার প্রার্থনা এই যে—” সুজা কহিলেন, “ব্ৰাহ্মণ, তোমার প্রার্থনা আমি নিশ্চয় পূরণ করিব। কিন্তু কিছুদিন সবুর করো ; এখন রাজকোষে অধিক অর্থ নাই।” রঘুপতি কহিলেন, “শাহেন-শা, রুপা সোনা বা আর-কোনো ধাতু চাহি না, আমি এখন শাণিত ইস্পাত চাই। আমার নালিশ শুনুন, আমি বিচার প্রার্থনা করি।” সুজা কহিলেন, “ভারি মুশকিল ! এখন আমার বিচার করিবার সময় নহে। ব্ৰাহ্মণ, তুমি বড়ো অসময়ে আসিয়াছ ।” রঘুপতি কহিলেন, “শাহজাদা, সময় অসময় সকলেরই আছে। আপনি বাদশাহ, আপনারও আছে ; এবং আমি দরিদ্র ব্ৰাহ্মণ, আমারও আছে । আপনার সময়মত আপনি বিচার করিতে বসিলে আমার সময় থাকে কোথা ?”