পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

Գ@ Օ রবীন্দ্র-রচনাবলী উনত্রিংশ পরিচ্ছেদ এই উপন্যাসের আরম্ভকাল হইতে এখন দুই বৎসর হইয়া গিয়াছে। ধ্রুব তখন দুই বৎসরের বালক ছিল । এখন তাহার বয়স চার বৎসর। এখন সে বিস্তর কথা শিখিয়াছে। এখন তিনি আপনাকে ভাবি মস্ত লোক জ্ঞান করেন ; সকল কথা যদিও স্পষ্ট বলিতে পারেন না, কিন্তু অত্যন্ত জোরের সহিত বলিয়া থাকেন । রাজাকে প্রায় তিনি ‘পুতুল দেবী বলিয়া পরম প্রলোভন ও সাস্তুনা দিয়া থাকেন, এবং রাজা যদি কোনোপ্রকার দুষ্টুমির লক্ষণ প্রকাশ করেন তবে ধ্রুব তীকে ‘ঘরে বন্দ করে রাখব? বলিয়া অত্যন্ত শঙ্কিত করিয়া তুলেন । এইরূপে রাজা এখন বিশেষ শাসনে আছেন— ধ্রুবের অনভিমত কোনো কাজ করিতে তিনি বড়ো একটা ভরসা করেন না । ইতিমধ্যে হঠাৎ ধুবের একটি সঙ্গী জুটিয়া গেল। একটি প্রতিবেশীর মেয়ে, ধ্রুব অপেক্ষা ছয় মাসের ছোটাে । মিনিট দশেকের ভিতরে উভয়ের মধ্যে চিরস্থায়ী ভাব হইয়া গেল । মাঝে একটুখানি মনান্তর হইবারও সম্ভাবনা হইয়াছিল। ধ্রুবের হাতে একটা বড়ো বাতাসা ছিল। প্রথম-প্ৰণয়ের উচ্ছাসে ধ্রুব তাহার দুইটি ছােটাে আঙুল দিয়া অতি সাবধানে ক্ষুদ্র একটু কণা ভাঙিয়া একেবারে তাহার সঙ্গিনীর মুখে পুরিয়া দিল ও পরম অনুগ্রহের সহিত ঘাড় নাড়িয়া কহিল, “তুমি কাও ৷” সঙ্গিনী মিষ্ট পাইয়া পরিতৃপ্ত হইয়া কহিল, “আরো কাব।” তখন ধ্রুব কিছু কাতর হইয়া পড়িল । বন্ধুত্বের উপরে এত অধিক দাবি ন্যায়সংগত বোধ হইল না ; ধ্রুব তাহার স্বভাবসুলভ গাভীর্য ও গৌরবের সহিত ঘাড় নাড়িয়া, চক্ষু বিস্ফারিত করিয়া কহিল, “ছি— আর কেতে নেই, অম্বুখ কোবে, বাবা মা’বে।” বলিয়াই অধিক বিলম্ব না করিয়া সমস্ত বাতাসটা নিজের মুখের মধ্যে একেবারে পুরিয়া দিয়া নিঃশেষ করিয়া ফেলিল । সহসা বালিকার মুখের মাংসপেশীর মধ্যে পরিবর্তন ঘটিতে লাগিল— ওষ্ঠাধর ফুলিতে লাগিল, ভুযুগ উপরে উঠিতে লাগিল— আসন্ন ক্ৰন্দনের সমস্ত লক্ষণ ব্যক্ত হইল। ধ্রুব কাহারও ক্ৰন্দন সহিতে পারিত না ; তাড়াতাড়ি সুগভীর সাস্তুনার স্বরে কহিল, “কাল দেব ।” রাজা আসিবামাত্র ধ্রুব অত্যন্ত বিজ্ঞা হইয়া নূতন সঙ্গিনীর প্রতি নির্দেশ করিয়া বলিয়া উঠিল, “একে কিছু বোলো না, এ কঁদবে। ছি, মারতে নেই, ছি!” রাজার কোনোপ্রকার দুরভিসন্ধি ছিল না। সত্য, তথাপি গায়ে পড়িয়া রাজাকে সাবধান করিয়া দেওয়া ধ্রুব অত্যন্ত আবশ্যক বিবেচনা করিল। রাজা মেয়েটিকে মারিলেন না, ধ্রুব স্পষ্টই দেখিল তাহার উপদেশ নিস্ফল নহে। তার পরে ধ্রুব মুরুবিবর ভাব ধারণ করিয়া কোনোপ্রকার বিপদের আশঙ্কা নাই জানাইয়া মেয়েটিকে পরম গাভীর্যের সহিত আশ্বাস দিবার চেষ্টা করিতে লাগিল । তাহারও কিছুমাত্র আবশ্যক ছিল না। কারণ, মেয়েটি আপনা হইতে নিভীক ভাবে রাজার কাছে গল্প মতান্ত কৌতুহল ও লোভের সহিত র্তাহার হাতের কঙ্কণ ঘুরাইয়া ঘুরাইয়া নিরীক্ষণ করিতে গল৷ ৷ ” এইরূপে ধ্রুব কেবলমাত্র নিজের যত্নে ও পরিশ্রমে পৃথিবীতে শান্তি ও প্ৰেম স্থাপন করিয়া প্ৰসন্নচিত্তে রাজার মুখের কাছে আপনার বেলফুলের মতো মোটা গোল কোমল পবিত্ৰ মুখখানি বাড়াইয়া দিল— রাজার সদব্যবহারের পুরস্কার- রাজা চুম্বন করিলেন । তখন ধ্রুব তাহার সঙ্গিনীর মুখ তুলিয়া ধরিয়া রাজাকে অনুমতি ও অনুরোধের মাঝামাঝি স্বরে কহিল, “একে চুমো কাও ৷” রাজা খুবের আদেশ লঙঘন করিতে সাহস করিলেন না। মেয়েটি তখন নিমন্ত্রণের কিছুমাত্র অপেক্ষা না করিয়া নিতান্ত অভ্যস্ত ভাবে অমানবদনে রাজার কোলের উপরে চড়িয়া বসিল । এতক্ষণ জগতে কোনোপ্রকার অশান্তি বা উচ্ছঙ্খলতার লক্ষণ ছিল না, কিন্তু এইবার ধুবের সিংহাসনে টান পড়িতেই তাহার সার্বভৌমিক প্ৰেম টলমল করিয়া উঠিল । রাজার কোলের ‘পরে