পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৩

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ ( S তাহার নিজের একমাত্র স্বত্ব সাব্যস্ত করিবার চেষ্টা বলবতী হইয়া উঠিল । মুখ অত্যন্ত ভার হইল, মেয়েটিকে দুই-একবার টানিল, এমন-কি, নিজের পক্ষে অবস্থাবিশেষে ছোটাে মেয়েকে মারাও ততটা অন্যায় বোধ হইল না | রাজা তখন মিটমাট করিবার উদ্দেশে ধ্রুবকেও তাহার আধখানা কোলে টানিয়া লইলেন । কিন্তু তাহাতেও খুবের আপত্তি দূর হইল না। অপরাধ অধিকার করিবার জন্য নূতন আক্রমণের উদযোগ করিতে লাগিল। এমন সময়ে নূতন রাজপুরোহিত বিন্ধন ঠাকুর ঘরে প্রবেশ করিলেন । রাজা উভয়কেই কোল হইতে নামাইয়া তঁহাকে প্ৰণাম করিলেন । ধ্রুবকে বলিলেন, “ঠাকুরকে প্ৰণাম করে ।” ধ্রুব তাহা আবশ্যক বোধ করিল না ; মুখে আঙুল পুরিয়া বিদ্রোহীভাবে দাড়াইয়া রহিল । মেয়েটি আপনা হইতেই রাজার দেখাদেখি পুরোহিতকে প্ৰণাম করিল। বিন্ধন ঠাকুর ধ্রুবকে কাছে টানিয়া লইয়া জিজ্ঞাসা করিলেন, “তোমার এ সঙ্গী জুটিল কোথা হইতে ?” ধ্রুব খানিকক্ষণ ভাবিয়া কহিল, “আমি টিকটক চ’ব ।” টকটক অর্থে ঘোড়া । পুরোহিত কহিলেন, “বাহবা, প্রশ্ন ও উত্তরের মধ্যে কী সামঞ্জস্য !” সহসা মেয়েটির দিকে ধ্রুবের চক্ষু পড়িল, তাহার সম্বন্ধে অতি সংক্ষেপে আপনার মত ও অভিপ্ৰায় ব্যক্ত করিয়া কহিল, “ও দুষ্ট, ওকে মা’ব ।” বলিয়া আকাশে আপনার ক্ষুদ্র মুষ্টি নিক্ষেপ করিল। রাজা গভীরভাবে কহিলেন, “ছি ধ্রুব !” একটি ফুয়ে যেমন প্ৰদীপ নিবিয়া যায় তেমনি তৎক্ষণাৎ ধ্রুবের মুখ স্নান হইয়া গেল । প্রথমে সে অশ্রুনিবারণের জন্য দুই মুষ্টি দিয়া দুই চক্ষু রাগড়াইতে লাগিল ; অবশেষে দেখিতে দেখিতে ক্ষুদ্র স্ফীত হৃদয় আর ধারণ করিতে পারিল না, কাদিয়া উঠিল । বিন্ধন ঠাকুর তাহাকে নাড়িয়া-চাড়িয়া, কোলে লইয়া, আকাশে তুলিয়া, ভূমিতে নামাইয়া, অস্থির করিয়া তুলিলেন ; উচ্চৈঃস্বরে ও দ্রুত উচ্চারণে বলিলেন, “শোনো শোনো ধ্রুব, শোনো, তোমাকে শ্লোক বলি শোনো কলহ কটকটাং কাঠ কাঠিন্য কাঠ্যং কটন কিটন কীটং কুটুমলং খট্টমট্রিং। অর্থাৎ কিনা, যে ছেলে কঁদে তাকে কলহ কটুকটাঙের মধ্যে পুরে খুব করে কাঠ কাঠিন্য কাঠ্যং দিতে হয়, তার পরে এতগুলো কটন কিটন কিটিং নিয়ে একেবারে তিন দিন ধরে কুটুমলং খট্টমট্রিং ।” পুরোহিত ঠাকুর এইরূপ অনর্গল বকিয়া গেলেন । ধ্রুবের ক্ৰন্দন অসম্পূর্ণ অবস্থাতেই একেবারে লুপ্ত হইয়া গেল। সে প্রথমে গােলমালে বিব্রত ও অবাক হইয়া বিন্ধন ঠাকুরের মুখের দিকে সজল চক্ষু তুলিয়া চাহিয়া রহিল। তার পরে তার হাতমুখ নাড়া দেখিয়া তাহার অত্যন্ত কৌতুক বোধ হইল । সে ভারি খুশি হইয়া বলিল, “আবার বলে ।” পুরোহিত আবার বকিয়া গেলেন । ধ্রুব অত্যন্ত হাসিতে হাসিতে বলিল, “আবার বলে ।” রাজা ধুবের অশ্রুসিক্ত কপোলে এবং হাসিভরা অধরে বার বার চুম্বন করিলেন । তখন রাজা রাজপুরোহিত ও দুটি ছেলেমেয়ে মিলিয়া খেলা পড়িয়া গেল । বিন্ধন ঠাকুর রাজাকে কহিলেন, “মহারাজ ইহাদের লইয়া বেশ আছেন । দিনরাত প্রখর বুদ্ধিমানদের সঙ্গে থাকিলে বুদ্ধি লোপ পায় । ছুরিতে অবিশ্রাম শান পড়িলে ছুরি ক্রমেই সূক্ষ্ম হইয়া অন্তধান করে । একটা মোটা বাট কেবল অবশিষ্ট থাকে ৷” রাজা হাসিয়া কহিলেন, “এখনো তবে বোধ করি আমার সূক্ষ্ম বুদ্ধির লক্ষণ প্রকাশ পায় নাই।” বিন্ধন । না। সূক্ষ্ম বুদ্ধির একটা লক্ষণ এই যে, তাহা সহজ জিনিসকে শক্ত করিয়া তুলে । পৃথিবীতে বিস্তর বুদ্ধিমান না থাকিলে পৃথিবীর কাজ অনেকটা সোজা হইত। নানারূপ সুবিধা করিতে গিয়াই নানারূপ অসুবিধা ঘটে । অধিক বুদ্ধি লইয়া মানুষ কী করিবে ভাবিয়া পায় না।