পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি Գ ( (; আপনাকে দিলাম- আপনি লেখাপড়া করিয়া লউন ৷” রঘুপতি কহিলেন, “সে-সকল পরে দেখা যাইবে।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “পরে কেন, আমি এখনি দিব । সমস্ত কয়লােসর পরগনা আপনারই হইল ; আমি এক পয়সা খাজনা লইব না।” বলিয়া নক্ষত্ররায় মাথা তুলিয়া অত্যন্ত সিধা হইয়া বসিলেন । রঘুপতি কহিলেন, “মরিবার জন্য তিন হাত জমি মিলিলেই সুখী হইব । আমি আর-কিছু চাহি না ।” বুলিয়া রঘুপতি চলিয়া গেলেন । তাহার জয়সিংহকে মনে পড়িয়াছে। জয়সিংহ যদি থাকিত তবে । পুরস্কারের স্বরূপ কিছু লইতেন— জয়সিংহ যখন নাই তখন সমস্ত ত্রিপুরা রাজা মৃত্তিকার সমষ্টি ছাড়া আর-কিছু মনে হইল না । রঘুপতি এখন নক্ষত্ররায়কে রাজাভিমানে মত্ত করিবার চেষ্টা করিতেছেন । র্তাহার মনের মধ্যে ভয় আছে পাছে এত আয়োজন করিয়া সমস্ত ব্যর্থ হয়, পাছে দুর্বলম্বভাব নক্ষত্ররায় ত্রিপুরায় গিয়া বিনাযুদ্ধে রাজার নিকট ধরা দেন । কিন্তু দুর্বল হৃদয়ে একবার রাজ্যমন্দ জন্মিলে আর ভাবনা নাই। রঘুপতি নক্ষত্ররায়ের প্রতি আর অবজ্ঞা প্ৰদৰ্শন করেন না, কথায় কথায় তাহার সম্মান দেখাইয়া থাকেন । সকল | বিষয়ে তাহার মৌখিক আদেশ লইয়া থাকেন । মোগল-সৈন্যেরা তাহাকে মহারাজা সাহেব বলে, সাহাকে দেখিলে শশব্যস্ত হইয়া উঠে- বায়ু বহিলে যেমন সমস্ত শস্যক্ষেত্র নত হইয়া যায় তেমনি নক্ষত্ররায় আসিয়া দাড়াইলে সারি সারি মোগল-সেনা একসঙ্গে মাথা নত করিয়া সেলাম করে । সেনাপতি সসম্রামে তাহাকে অভিবাদন করেন । শত শত মুক্ত তরবারির জ্যোতির মধ্যে বৃহৎ হস্তীর পৃষ্ঠে রাজচিহ্ন-অঙ্কিত স্বর্ণমণ্ডিত হাওদায় চড়িয়া তিনি যাত্রা করেন, সঙ্গে সঙ্গে উল্লাসজনক বাদ্য বাজিতে থাকে- সঙ্গে সঙ্গে নিশানধারী রাজনিশান ধরিয়া চলে । তিনি যেখান দিয়া যান, সেখানকার গ্রামের লোক সৈন্যের ভয়ে ঘরবাড়ি ছাড়িয়া পালাইয়া যায় । তাহাদের ত্ৰাস দেখিয়া নক্ষত্ররায়ের মনে গর্বের উদয় হয় । তাহার মনে হয়, আমি দিগ্বিজয় করিয়া চলিয়াছি । ছোটো ছোটো জমিদারগণ নানাবিধ উপটৌকন লইয়া আসিয়া তাহাকে সেলাম করিয়া যায়- তাহাদিগকে পরাজিত নৃপতি বলিয়া বোধ হয় ; মহাভারতের দিগ্বিজয়ী পাণ্ডবদের কথা মনে পড়ে । একদিন সৈন্যেরা আসিয়া সেলাম করিয়া কহিল, “মহারাজা সাহেব !” নক্ষত্ররায় খাড়া হইয়া বসিলেন । “আমরা মহারাজের জন্য জান দিতে আসিয়াছি- আমরা জানের পরোয় রাখি না । বরাবর আমাদের দস্তুর আছে, লড়াইয়ে যাইবার পথে আমরা গ্ৰাম লুঠ করিয়া যাই— কোনো শাস্ত্রে ইহাতে (लास क्लिश का ।" নক্ষত্ররায় মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “ঠিক কথা, ঠিক কথা ।” সৈন্যেরা কহিল, “ব্ৰাহ্মণ-ঠাকুর আমাদের লুঠ করিতে বারণ করিয়াছেন। আমরা জান দিতে যাইতেছি, অথচ একটু লুঠ করিতে পারিব না, এ বড়ো অবিচার ।” নক্ষত্ররায় পুনশ্চ মাথা নাড়িয়া কহিলেন, “ঠিক কথা, ঠিক কথা ।” “মহারাজার যদি হুকুম মিলে তো আমরা ব্ৰাহ্মণ-ঠাকুরের কথা না মানিয়া লুঠ করিতে যাই।” নক্ষত্ররায় অত্যন্ত স্পর্ধার সহিত কহিলেন, “ব্ৰাহ্মণ-ঠাকুর কে ! ব্ৰাহ্মণ-ঠাকুর কী জানে ! আমি তোমাদিগকে হুকুম দিতেছি তোমরা লুঠপট করিতে যাও।” বলিয়া একবার ইতস্তত চাহিয়া দেখিলেন, কোথাও রঘুপতিকে না দেখিয়া নিশ্চিন্ত হইলেন । কিন্তু রঘুপতিকে এইরূপে অকাতরে লঙ্ঘন করিয়া তিনি মনের মধ্যে অত্যন্ত আনন্দ লাভ করিলেন । ক্ষমতামদ মন্দিরার মতো তাহার শিরায় শিরায় সঞ্চারিত হইতে লাগিল । পৃথিবীকে নূতন চক্ষে দেখিতে লাগিলেন। কাল্পনিক বেলুনের উপর চড়িয়া পৃথিবীটা যেন অনেক নিম্নে মেঘের মতো মিলাইয়া গেল। এমন-কি, মাঝে মাঝে কদাচ কখনাে রঘুপতিকেও নগণ্য বলিয়া মনে হইতে লাগিল । সহসা বলপূর্বক গোবিন্দমাণিক্যের প্রতি অত্যন্ত ক্রুদ্ধ হইয়া উঠিলেন। মনে মনে বার বার করিয়া