পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৮৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

aQや রবীন্দ্র-রচনাবলী বলিতে লাগিলেন, “আমাকে নির্বাসন ! একটা সামান্য প্রজার মতো আমাকে বিচারসভায় আহিব এবার দেখি কে কাহাকে নির্বাসিত করে । এবার ত্রিপুরাসুদ্ধ লোক নক্ষত্ররায়ের প্রতাপ অব হইবে ।” নক্ষত্ররায় ভারি উৎফুল্ল ও স্ফীত হইলেন । নিরীহ গ্রামবাসীদের উপর অনর্থক উৎপীড়ন ও লুঠপাটের প্রতি রঘুপতির বিশেষ বিরাগ ছিল। র্তাহাকে অবহেলা করিল। তিনি নক্ষত্ররায়ের কাছে আসিয়া বলিলেন, “অসহায় গ্রামবাসীদের উপাত্ত কেন এ অত্যাচার !” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “ঠাকুর, এ-সব বিষয়ে তুমি ভালো বোঝা না । যুদ্ধবিগ্রহের সময় সৈন্যদের লুঠপাটে নিষেধ করিয়া নিরুৎসাহ করা ভালো নয়।” নক্ষত্ররায়ের কথা শুনিয়া রঘুপতি কিঞ্চিৎ বিস্মিত হইলেন । সহসা নক্ষত্ররায়ের শ্রেষ্ঠত্বাভিমান দেখিয়া তিনি মনে মনে হাসিলেন । কহিলেন, “এখন লুঠপট করিতে দিলে পরে ইহাদিগকে সামলানো দায় হইবে । সমস্ত ত্রিপুরা লুঠিয়া লইবে ।” নক্ষত্ররায় কহিলেন, “তাহাতে হানি কী ? আমি তো তাহাই চাই । ত্রিপুরা একবার বুক, নক্ষত্ররায়কে নির্বাসিত করার ফল কী । ঠাকুর, এ-সব বিষয় তুমি কিছু বোঝা না— তুমি তো কখনো রঘুপতি মনে মনে অত্যন্ত আমোদ বোধ করিলেন । কিছু উত্তর না করিয়া চলিয়া গেলেন । নক্ষত্ররায় নিতান্ত পুত্তলিকার মতো না হইয়া একটু শক্ত মানুষের মতো হন, এই তাহার ইচ্ছা ছিল । দ্বাত্রিংশ পরিচ্ছেদ ত্রিপুরায় ইদুরের উৎপাত যখন আরম্ভ হয় তখন শ্রাবণ মাস। তখন ক্ষেত্রে কেবল ভুট্ট ফলিয়াছিল, এবং পাহাড়ে জমিতে ধান্যক্ষেত্রেও পাক ধরিতে আরম্ভ করিয়াছিল । তিন মাস কোনোমতে কাটিয়া গেল— অগ্রহায়ণ মাসে নিম্নভূমিতে যখন ধান কাটিবার সময় আসিল তখন দেশে আনন্দ পড়িয়া গেল । চাষারা’ স্ত্রীলোক বালক যুবক বৃদ্ধ সকলে মিলিয়া দা হাতে লইয়া ক্ষেত্রে গিয়া পড়িল । হৈয়া হৈয়া শব্দে পরস্পর পরস্পরকে আহবান করিতে লাগিল। জুমিয়া রমণীদের গানে মাঠ-বাট ধ্বনিত হইয়া উঠিল । রাজার প্রতি অসন্তোষ দূর হইয়া গেল— রাজ্যে শান্তি স্থাপিত হইল । এমন সময় সংবাদ আসিল, নক্ষত্ররায় রাজ্য-আক্রমণের উদ্দেশ্যে বহুসংখ্যক সৈন্য লইয়া ত্রিপুর রাজ্যের সীমানায় আসিয়া পৌঁছিয়াছেন এবং অত্যন্ত লুঠপাট উৎপীড়ন আরম্ভ করিয়া দিয়াছেন— এই সংবাদে সমস্ত রাজ্য শঙ্কিত হইয়া উঠিল । এ সংবাদ রাজার বক্ষে ছুরির মতো বিদ্ধ হইল । সমস্ত দিনই তাহাকে বিধিতে লাগিল । থাকিয়া কিয়া কেবলই প্রত্যেক বার নূতন করিয়া তাহার মনে হইতে লাগিল নক্ষত্ররায় তাহাকে আক্রমণ করিতে আসিতেছে। নক্ষত্ররায়ের সরল সুন্দর মুখ শতবার তাহার স্নেহচক্ষের সম্মুখে দেখিতে লাগিলেন এবং সেই সঙ্গেই মনে হইতে লাগিল, সেই নক্ষত্ররায় কতকগুলো সৈন্য সংগ্ৰহ করিয়া তলোয়ার হাতে লইয়া তাহাকে আক্রমণ করিতে আসিতেছে। এক-একবার তাহার মনে মনে ইচ্ছা! করিতে লাগিল একটি সৈন্যও না লইয়া নক্ষত্ররায়ের সম্মুখে বৃহৎ রণক্ষেত্রে একা দাড়াইয়া সমস্ত বক্ষঃস্থল অবারিত করিয়া নক্ষত্ররায়ের সহস্র সৈনিকের তরবারি এক কালে তাহার হৃদয়ে গ্ৰহণ করেন । তিনি ধ্রুবকে কাছে টানিয়া বলিলেন, “খুব, তুইও কি এই মুকুটখানার জন্য আমার সঙ্গে ঝগড়া ১ প্রকৃতপক্ষে ইহাদের চাষা বলা যায় না। কারণ, ইহারা রীতিমত চাষ করে না। জঙ্গল দগ্ধ করিয়া বর্ষারম্ভে বীজ বপণ করে মাত্র । এইরূপ ক্ষেত্ৰকে জুম বলে, কৃষকদিগকে জুমিয়া বলে ।