পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ԳN28 রবীন্দ্র-রচনাবলী রাজা কাতর হইয়া কহিলেন, “আমি বনে যাইব না ; আমি ধনজন লইয়া লোকালয়ে থাকিব ।” কেদারেশ্বর কহিল, “আমি দেশ ছাড়িয়া যাইতে পারিব না ।” রাজা কিছু না বলিয়া গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন । র্তাহার সমস্ত আশা ম্রিয়মাণ হইয়া গেল। নিমেষের মধ্যে সমস্ত ধরণীর মুখ যেন পরিবর্তিত হইয়া গেল। ধ্রুব আপন মনে খেলা করিতেছিলঅনেকক্ষণ তাহার দিকে চাহিয়া রহিলেন। অথচ তাহাকে যেন চােখে দেখিতে পাইলেন না। ধ্রুব তাহার কাপড়ের প্রান্ত ধরিয়া টানিয়া কহিল, “খেলা করো ।” রাজার সমস্ত হৃদয় গলিয়া অশ্রু হইয়া চোখের কাছে আসিল, অনেক কষ্টে অশ্রািজল দমন করিলেন । মুখ ফিরাইয়া ভগ্নহৃদয়ে কহিলেন, “তবে ধ্রুব রহিল। আমি একাই যাই।” অবশিষ্ট জীবনের সুদীর্ঘ মরুময় পথ যেন নিমেষের মধ্যে বিদ্যুদালোকে তাহার চক্ষুতারকায় অঙ্কিত হইল । কেদারেশ্বর ধ্রুবর খেলা ভাঙিয়া দিয়া তাহাকে বলিল, “আয়, আমার সঙ্গে আয় ।” বলিয়া তাহার হাত ধরিয়া টানিল । ধ্রুব ক্ৰন্দনের স্বরে বলিয়া উঠিল, “না।” তাড়াতাড়ি তাহার দুই হাঁটুর মধ্যে মুখ লুকাইল । রাজা ধ্রুবকে কোলে তুলিয়া লইয়া তাহাকে বুকের মধ্যে চাপিয়া রাখিলেন । বিশাল হৃদয় বিদীর্ণ হইতে চাহিতেছিল, ক্ষুদ্র ধ্রুবকে বুকের কাছে চাপিয়া হৃদয়কে দমন করিলেন । ধ্রুবকে সেই অবস্থায় কোলে রাখিয়া তিনি দীর্ঘ। কক্ষে পদচারণ করিতে লাগিলেন । ধ্রুব কঁধে মাথা রাখিয়া অত্যন্ত স্থির হইয়া পড়িয়া রহিল। অবশেষে যাত্রার সময় হইল। ধ্রুব রাজার কোলে ঘুমাইয়া পড়িয়াছে। ঘুমন্ত ধ্রুবকে ধীরে ধীরে কেদারেশ্বরের হস্তে সমপণ করিয়া রাজা যাত্ৰা করিলেন । সপ্তত্রিংশ পরিচ্ছেদ পূর্বদ্বার দিয়া সৈন্যসামন্ত লইয়া নক্ষত্রমাণিক্য রাজধানীতে প্রবেশ করিলেন, কিঞ্চিৎ অর্থ ও গুটিকতক অনুচর লইয়া পশ্চিম দ্বারাভিমুখে গোবিন্দমাণিক্য যাত্ৰা করিলেন । নগরের লোক বাশি বাজাইয়া ঢাকঢোলের শব্দ করিয়া হুলুধ্বনি ও শঙ্খধ্বনির সহিত নক্ষত্ররায়কে আহবান করিল। গোবিন্দমাণিক্য যে পথ দিয়া অশ্বারোহণে যাইতেছিলেন সে পথে কেহই তাহাকে সমাদর করা আবশ্যক বিবেচনা করিল না । দুই পাশ্বের কুটিরবাসিনী রমণীরা তাহাকে শুনাইয়া শুনাইয়া গালি দিতে লাগিল, ক্ষুধায় ও ক্ষুধিত সন্তানদের ক্ৰন্দনে তাহাদের জিহবা শাণিত হইয়াছে। পরশ্ব গুরুতর দুর্ভিক্ষের সময় যে বৃদ্ধ রাজদ্বারে গিয়া আহার পাইয়াছিল এবং রাজা স্বয়ং যাহাকে সাস্তুনা দিয়াছিলেন সে তাহার শীর্ণ হস্ত তুলিয়া, রাজাকে অভিশাপ দিতে লাগিল । ছেলেরা জননীর কােছ হইতে শিক্ষা পাইয়া বিদ্রুপ করিয়া চীৎকার করিতে করিতে রাজার পিছন পিছন চলিল । দক্ষিণে বামে কোনাে দিকে দৃষ্টিপাত না করিয়া সম্মুখে চাহিয়া রাজা ধীরে ধীরে চলিতে লাগিলেন। একজন জুমিয়া ক্ষেত্ৰ হইতে আসিতেছিল, সে রাজাকে দেখিয়া ভক্তিভরে প্রণাম করিল। রাজার হৃদয় আদ্ৰ হইয়া গেল। তিনি তাহার নিকটে স্নেহ-আকুল কণ্ঠে বিদায় প্রার্থনা করিলেন। কেবল এই একটি বিদায় দিল । রাজার পশ্চাতে ছেলের পাল চীৎকার করিতেছে দেখিয়া সে মহা ক্রুদ্ধ হইয়া তাহাদিগকে তাড়া করিয়া গেল । রাজা তাহাকে নিষেধ করিলেন । অবশেষে পথের যে অংশে কেদারেশ্বরের কুটির ছিল, রাজা সেইখানে আসিয়া উপস্থিত হইলেন । তখন একবার দক্ষিণে ফিরিয়া চাহিলেন। এখন শীতের প্রাতঃকাল । কুয়াশা কটিয়া সূর্যরশ্মি সবে দেখা দিয়াছে। কুটিরের দিকে চাহিয়া রাজার গত বৎসরের আষাঢ় মাসের এক প্ৰাতঃকাল মনে পড়িল । তখন ঘনমেঘ, ঘনবৰ্ষা । দ্বিতীয়ার ক্ষীণ চন্দ্রের ন্যায় বালিকা হাসি অচেতনে শয্যার প্রান্তে