পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৭৯৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি ԳV)Գ গোবিন্দমাণিক্যের প্রিয় সহচর ছিল, তাহারা যেন রাত্রিদিন নীরবে ছত্রমাণিক্যকে ভৎ সনা করিতে লাগিল। ছত্রমাণিক্যের ক্রমে তাহা অসহ্য বােধ হইতে লাগিল । তিনি চােখের সম্মুখ হইতে গোবিন্দমাণিক্যের সমস্ত চিহ্ন মুছিতে আরম্ভ করিলেন । গােবিন্দমাণিক্যের ব্যবহার্য সামগ্ৰী নষ্ট করিয়া ফেলিলেন এবং তাহার প্রিয় অনুচরদিগকে দূর করিয়া দিলেন । গোবিন্দমাণিক্যের নামগন্ধ তিনি আর সহ্য করিতে পারিতেন না । গোবিন্দমাণিক্যের কোনো উল্লেখ হইলেই তাহার মনে হইত সকলে তাহাকে লক্ষ্য করিয়াই এই উল্লেখ করিতেছে। সর্বদা মনে হইত সকলে তাহাকে রাজা বলিয়া যথেষ্ট সম্মান করিতেছে না ; এইজন্য সহসা অকারণে ক্ষাপা হইয়া উঠিতেন, সভাসদদিগকে শশব্যস্ত থাকিতে श्ऊ | বলিতেন, “আমি আর এইটে বুঝি নে ! তুমি কি আমাকে নির্বোধি পাইয়াছ !” তাহার মনে হইত, সকলে তাহাকে সিংহাসনে অনধিকারী রাজাপহারিক জ্ঞান করিয়া মনে মনে তাচ্ছিল্য করিতেছে । এইজন্য সজোরে অত্যধিক রাজা হইয়া উঠিলেন ; যথেচ্ছাচরণ করিয়া সর্বত্র তাহার একাধিপত্য প্রচার করিতে লাগিলেন । তিনি যে রাখিলে রাখিতে পারেন, মারিলে মারিতে পারেন, ইহা বিশেষরূপে প্ৰমাণ করিবার জন্য যাহাকে রাখা উচিত নহে তাহাকে রাখিলেন— যাহাকে মারা উচিত নহে তাহাকে মারিলেন । প্ৰজারা অন্নাভাবে মরিতেছে, কিন্তু তাহার দিনরাত্ৰি সমারোহের শেষ নাই— অহরহ নৃত্য গীত বাদ্য ভোজ । ইতিপূর্বে আর-কোনো রাজা সিংহাসনে চড়িয়া বসিয়া রাজত্বের পেখম সমস্তটা ছড়াইয়া দিয়া এমন অপূর্ব নৃত্য করে নাই । প্ৰজারা চারি দিকে অসন্তোষ প্ৰকাশ করিতে লাগিল-— ছত্ৰমাণিক্য তাহাতে অত্যন্ত জুলিয়া উঠিলেন ; তিনি মনে করিলেন, এ কেবল রাজার প্রতি অসম্মানপ্রদর্শন । তিনি অসন্তোষের দ্বিগুণ কারণ জন্মাইয়া দিয়া বলপূর্বক পীড়নপূর্বক ভয় দেখাইয়া সকলের মুখ বন্ধ করিয়া দিলেন, সমস্ত রাজ্য নিদ্রিত নিশীথের মতো নীরব হইয়া গেল । সেই শান্ত নক্ষত্ররায় ছত্রমাণিক্য হইয়া যে সহসা এরূপ আচরণ করবেন, ইহাতে আশ্চর্যের বিষয় কিছুই নাই। অনেক সময়ে দুর্বল হৃদয়েরা প্ৰভুত্ব পাইলে এইরূপ প্ৰচণ্ড ও যথেচ্ছাচারী হইয়া উঠে । রঘুপতির কাজ শেষ হইয়া গেল। শেষ পর্যন্তই প্রতিহিংসাপ্রবৃত্তি তাহার হৃদয়ে সমান জাগ্রত ছিল তাহা নহে। ক্রমে প্রতিহিংসার ভাব ঘুচিয়া গিয়া যে কাজে হাত দিয়াছেন সেই কাজটা সম্পন্ন করিয়া তোলাই তাহার একমাত্র ব্রত হইয়া উঠিয়াছিল । নানা কৌশলে বাধাবিপত্তি সমস্ত অতিক্রম করিয়া দিনরাত্রি একটা উদ্দেশ্যসাধনে নিযুক্ত থাকিয়া তিনি একপ্রকার মাদক সুখ অনুভব করিতেছিলেন । অবশেষে সেই উদ্দেশ্য সিদ্ধ হইয়া গেল । পৃথিবীতে আর কোথাও সুখ নাই । রঘুপতি তাহার মন্দিরে গিয়া দেখিলেন সেখানে জনপ্রাণী নাই। যদিও রঘুপতি বিলক্ষণ জানিতেন যে জয়সিংহ নাই, তথাপি মন্দিরে প্রবেশ করিয়া যেন দ্বিতীয় বার নূতন করিয়া জানিলেন যে, জয়সিংহ নাই। এক-একবার মনে হইতে লাগিল যেন আছে, তার পরে স্মরণ হইতে লাগিল যে নাই । সহসা বায়ুতে কপাট খুলিয়া গেল, তিনি চমকিয়া ফিরিয়া চাহিয়া দেখিলেন, জয়সিংহ আসিল না। জয়সিংহ যে ঘরে থাকিত মনে হইল সে ঘরে জয়সিংহ থাকিতেও পারে- কিন্তু অনেকক্ষণ সে ঘরে প্রবেশ করিতে পারিলেন না, মনে ভয় হইতে লাগিল পাছে গিয়া দেখেন জয়সিংহ সেখানে নাই । অবশেষে যখন গােধূলির ঈষৎ অন্ধকারে বনের ছায়া গাঢ়তর ছায়ায় মিলাইয়া গেল তখন রঘুপতি ধীরে ধীরে জয়সিংহের গৃহে প্রবেশ করিলেন— শূন্য বিজন গৃহ সমাধিভবনের মতাে নিস্তব্ধ। ঘরের মধ্যে এক পাশে একটি কাঠের সিন্দুক এবং সিন্দুকের পার্থে জয়সিংহের একজোড়া খড়ম ধূলিমলিন হইয়া পড়িয়া আছে। ভিত্তিতে জয়সিংহের স্বহস্তে আঁকা কালীমূর্তি। ঘরের পূর্বকোণে একটি ধাতুপ্ৰদীপ ধাতু-আধারের উপর দাড়াইয়া আছে, গত বৎসর হইতে সে প্রদীপ কেহ জ্বালায় নাই— মাকড়সার জালে সে আচ্ছন্ন হইয়া গিয়াছে। নিকটবতী দেয়ালে প্রদীপশিখার কালো দাগ পড়িয়া আছে । গৃহে পূর্বোক্ত কয়েকটি দ্রব্য ছাড়া আর কিছুই নাই। রঘুপতি গভীর দীর্ঘনিশ্বাস ফেলিলেন। সে