পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

ዓዒ S রবীন্দ্র-রচনাবলী দ্বাচ্যুত্বারিংশ পরিচ্ছেদ চট্টগ্রাম এখন আরাকানের অধীন। গােবিন্দমাণিক্য নির্বাসিতভাবে চট্টগ্রামে আসিয়াছেন শুনিয়া আরাকানের রাজা মহাসমারোহপূর্বক তাহার নিকট দূত প্রেরণ করিলেন। বলিয়া পাঠাইলেন, যদি সিংহাসন পুনরায় অধিকার করিতে চান, তাহা হইলে আরাকানপতি র্তাহাকে সাহায্য করিতে পারেন। গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, “না, আমি সিংহাসন চাই না। ” م দূত কহিল, “তবে আরাকান-রাজসভায় পূজনীয় অতিথি হইয়া মহারাজ কিছু কাল বাস করুন।” রাজা কহিলেন, “আমি রাজসভায় থাকিব না। চট্টগ্রামের এক পার্থে আমাকে স্থান দান করিলে আমি আরাকানরাজের নিকটে ঋণী হইয়া থাকিব ।” দূত কহিল, “মহারাজের যেখানে অভিরুচি সেইখানেই থাকিতে পারেন । এ-সমস্ত আপনারই রাজা মনে করিবেন ।” আরাকানরাজের কতকগুলি অনুচর রাজার সঙ্গে সঙ্গেই রহিল । গোবিন্দমাণিক্য তাহাদিগকে নিষেধ করিলেন না ; তিনি মনে করিলেন, হয়তাে বা আরাকানপতি তীহাকে সন্দেহ করিয়া তাহার নিকট লোক রাখিতে ইচ্ছা করেন । ময়ানি নদীর ধারে মহারাজ কুটির বঁাধিয়াছেন। স্বচ্ছসলিলা ক্ষুদ্র নদী ছোটাে বড়ো শিলাখণ্ডের উপর দিয়া দ্রুতবেগে চলিয়াছে। দুই পার্থে কৃষ্ণবর্ণের পাহাড় খাড়া হইয়া আছে, কালো পাথরের উপর বিচিত্র বর্ণের শৈবাল বুলিতেছে, মাঝে মাঝে ছোটাে ছোটাে গহবর আছে, তাহার মধ্যে পাখি বাসা করিয়াছে। স্থানে স্থানে দুই পার্থের পাহাড় এত উচ্চ যে, অনেক বিলম্বে সূর্যের দুই-একটি কর নদীর জলে আসিয়া পতিত হয় । বড়ো বড়ো গুল্ম বিবিধ আকারের পল্লব বিস্তার করিয়া পাহাড়ের গাত্রে বুলিতেছে। মাঝে মাঝে নদীর দুই তীরে ঘন জঙ্গলের বাহু অনেক দূর পর্যন্ত চলিয়া গিয়াছে। একটা দীর্ঘ শাখাহীন শ্বেত গর্জনবৃক্ষ পাহাড়ের উপরে হেলিয়া রহিয়াছে, নীচে নদীর চঞ্চল জলে তাহার ছায়া নাচিতেছে, বড়ো বড়ো লতা তাহাকে আচ্ছন্ন করিয়া বুলিয়া রহিয়াছে | ঘন সবুজ জঙ্গলের মাঝে মাঝে স্নিগ্ধ শ্যামল কদলীবন । মাঝে মাঝে দুই তীর বিদীর্ণ করিয়া ছোটাে ছোটাে নির্বর শিশুদিগের ন্যায় আকুল বাহু, চঞ্চল আবেগ ও কলকল শুভ্ৰ হাস্য লইয়া নদীতে আসিয়া পড়িতেছে। নদী কিছুদূর সমভাবে গিয়া স্থানে স্থানে শিলাসোপান বাহিয়া ফেনাইয়া নিম্নাভিমুখে ঝরিয়া পড়িতেছে। সেই অবিশ্রাম ঝবার শব্দ নিস্তব্ধ শৈলপ্রাচীরে প্রতিধবনিত হইতেছে । এই ছায়াশীতল প্রবাহের স্নিগ্ধ বাবার শব্দের মধ্যে স্তব্ধ শৈলতলে গোবিন্দমাণিক্য বাস করিতে লাগিলেন । হৃদয় বিস্তারিত করিয়া দিয়া হৃদয়ের মধ্যে শান্তি সঞ্চয় করিতে লাগিলেন— নির্জন প্রকৃতির সাত্মনাময় গভীর প্ৰেম নানা দিক দিয়া সহস্র নিবারের মতো তাহার হৃদয়ের মধ্যে পড়িতে লাগিল । তিনি আপনার হৃদয়ের গুহার মধ্যে প্রবেশ করিয়া সেখান হইতে ক্ষুদ্র অভিমান-সকল মুছিয়া ফেলিতে লাগিলেন- দ্বার উন্মুক্ত করিয়া দিয়া আপনার মধ্যে বিমল আলোক ও বায়ুর প্রবাহ গ্ৰহণ করিতে লাগিলেন । কে তাহাকে দুঃখ দিয়াছে, ব্যথা দিয়াছে, কে র্তাহার মেহের বিনিময় দেয় নাই, কে তাহার নিকট হইতে এক হস্তে উপকার গ্রহণ করিয়া অপর হস্তে কৃতঘ্নতা অর্পণ করিয়াছে, কে তঁাহার নিকট সমাদৃত হইয়া তাহাকে অপমান করিয়াছে— সমস্ত তিনি ভুলিয়া গেলেন । এই অতি পুরাতন প্রকৃতির অবিশ্রাম কার্যশীলতা অথচ চিরনিশ্চিন্তু প্রশান্ত নবীনতা দেখিয়া তিনি নিজেও যেন সেইরূপ পুরাতন, সেইরূপ বৃহৎ, সেইরূপ প্রশান্ত হইয়া উঠিলেন। তিনি যেন সুদূর জগৎ পর্যন্ত আপনার কামনাশূন্য মেহ বিস্তারিত করিয়া দিলেন- সমস্ত বাসনা দূর করিয়া দিয়া জোড়হন্তে কহিলেন, “হে ঈশ্বর, পতনোন্মুখ সম্পৎশিখর হইতে তোমার ক্ৰোড়ের মধ্যে ধারণ করিয়া আমাকে এ যাত্রা রক্ষা করিয়াছ । আমি মরিতে বসিয়াছিলাম, আমি বঁাচিয়া গিয়াছি । যখন রাজা হইয়াছিলাম তখন আমি আমার মহত্ত্ব জানিতাম না, আজ সমস্ত পৃথিবীময় আমার মহত্ত্ব অনুভব করিতেছি।’ অবশেষে