পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮০৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

রাজর্ষি ዒዓx© দুই চক্ষে জল পড়িতে লাগিল ; বলিলেন, “মহারাজ, তুমি আমার স্নেহের ধ্রুবকে কাড়িয়া লইয়াছ, সে বেদনা এখনো হৃদয় হইতে সম্পূর্ণ যায় নাই । আজ আমি বুঝিতেছি যে, তুমি ভালোই করিয়াছ । আমি সেই বালকের প্রতি স্বার্থপর স্নেহে আমার সমুদয় কর্তব্য আমার জীবন বিসর্জন দিতেছিলাম। তুমি আমাকে বিপদ হইতে রক্ষা করিয়াছ । আমি ধ্রুবকে আমার সমস্ত পুণ্যের পুরস্কার বলিয়া গ্ৰহণ করিয়াছিলাম ; তুমি তাহাকে কাড়িয়া লইয়া শিক্ষা দিতেছ যে, পুণ্যের পুরস্কার পুণ্য। তাই আজ সেই ধ্ৰুবের পবিত্র বিরহাদুঃখকে সুখ বলিয়া, তোমার প্রসাদ বলিয়া অনুভব করিতেছি। আমি বেতন লইয়া ভূত্যের মতো কাজ করিব না প্ৰভু, আমি তােমার প্রেমের বশ হইয়া তোমার সেবা করিব।” গোবিন্দমাণিক্য দেখিলেন, নির্জনে ধ্যান্যপরায়ণা প্রকৃতি যে স্নেহধারা সঞ্চয় করিতেছে, সজনে লোকালয়ের মধ্যে তাঁহা নদীরূপে প্রেরণ করিতেছে- যে তাহা গ্রহণ করিতেছে তাহার তৃষ্ণা নিবারণ হইতেছে, যে করিতেছে না। তাহার প্রতিও প্রকৃতির কোনো অভিমান নাই । গোবিন্দমাণিক্য কহিলেন, ‘আমিও আমার এই বিজনে সঞ্চিত প্ৰেম সজনে বিতরণ করিতে বাহির হইব ।’ বলিয়া তাহার পর্বতাশ্রম ছাড়িয়া তিনি বাহির হইলেন । সহসা রাজত্ব ছাড়িয়া দিয়া উদাসীন হওয়া, লেখায় যতটা সহজ মনে হয় বাস্তবিক ততটা সহজ নহে । রাজবেশ ছাড়িয়া দিয়া গেরুয়া বস্ত্র পর নিতান্ত অল্প কথা নহে । বরঞ্চ রাজ্য পরিত্যাগ করা তাহারা তাহাদের তীব্র ক্ষুধাতৃষ্ণা লইয়া আমাদের অস্থিমাংসের সহিত লিপ্ত হইয়া আছে ; তাহাদিগকে নিয়মিত খোরাক না জোগাইলে তাহারা আমাদের রক্তশোষণ করিতে থাকে । কেহ যেন মনে না করেন যে গোবিন্দমাণিক্য যতদিন তাহার বিজন কুটিরে বাস করিতেছিলেন, ততদিন কেবল অবিচলিত চিত্তে স্থাণুর মতো বসিয়া ছিলেন । তিনি পদে পদে আপনার সহস্ৰ ক্ষুদ্র অভ্যাসের সহিত যুদ্ধ করিতেছিলেন । যখনই কিছুর অভাবে, তাহার হৃদয় কাতর হইতেছিল তখনই তিনি তাহাকে ভৎসনা করিতেছিলেন । তিনি তাহার মনের সহস্রমুখী ক্ষুধাকে কিছু না খাইতে দিয়া বিনাশ করিতেছিলেন । পদে পদে এই শত শত অভাবের উপর জয়ী হইয়া তিনি সুখলাভ করিতেছিলেন । যেমন দুরন্ত অশ্বকে দ্রুতবেগে ছুটাইয়া শান্ত করিতে হয়, তেমনি তিনি তাহার অভাবকাতর অশাস্ত হৃদয়কে অভাবের মরুময় প্রান্তরের মধ্যে অবিশ্রাম দৌড় করাইয়া শান্ত করিতেছিলেন । অনেক দিন পর্যন্ত এক মুহূর্তও তাহার বিশ্রাম ছিল না । পার্বত্য প্রদেশ ছাড়িয়া গোবিন্দমাণিক্য দক্ষিণে সমুদ্রাভিমুখে চলিতে লাগিলেন । সমস্ত বাসনার দ্রব্য বিসর্জন দিয়া তিনি হৃদয়ের মধ্যে আশ্চর্য স্বাধীনতা অনুভব করিতে লাগিলেন । কেহ তাহাকে আর বঁাধিতে পারে না, অগ্রসর হইবার সময় কেহ তাহাকে আর বাধা দিতে পারে না । প্রকৃতিকে অত্যন্ত বৃহৎ দেখিলেন এবং আপনাকেও তাহার সহিত এক বলিয়া মনে হইল। বৃক্ষলতার সে এক নূতন শ্যামল বর্ণ, সূর্যের সে এক নূতন কনককিরণ, প্রকৃতির সে এক নূতন মুখশ্ৰী দেখিতে লাগিলেন । গ্রামে গিয়া মানবের প্রত্যেক কাজের মধ্যে তিনি এক নূতন সৌন্দর্য দেখিতে লাগিলেন । মানবের হাস্যালাপ, ওঠাবসা, চলাফেরার মধ্যে তিনি এক অপূর্ব নৃত্যগীতের মাধুরী দেখিতে পাইলেন । যাহাকে দেখিলেন তাহাকে কাছে ডাকিয়া কথা কহিয়া সুখ পাইলেন- যে তঁাহাকে উপেক্ষা প্রদর্শন করিল তাহার নিকট হইতে র্তাহার হৃদয় দূরে গমন করিল না। সর্বত্র দুর্বলকে সাহায্য করিতে এবং দুঃখীকে সাত্বনা দিতে ইচ্ছা করিতে লাগিল। তাহার মনে হইতে লাগিল, “আমার নিজের সমস্ত বল এবং সমস্ত সুখ আমি পরের জন্য উৎসর্গ করিলাম, কেননা আমার নিজের কোনো কাজ নাই, কোনো বাসনা নাই ।” সচরাচর যে-সকল দৃশ্য কাহারও চােখে পড়ে না, তাহা নূতন আকার ধারণ করিয়া তাহার চোখে পড়িতে লাগিল। যখন দুই ছেলেকে পথে বসিয়া খেলা করিতে দেখিতেন- দুই ভাইকে, পিতাপুত্রকে, মাতা ও শিশুকে একত্ৰ দেখিতেন— তাহারা ধূলিলিপ্ত হউক, দরিদ্র হউক, কদৰ্য হউক, তিনি তাঁহাদের মধ্যে দূরদূরান্তব্যাপী মানবহৃদয়সমুদ্রের অনন্ত গভীর প্রেম দেখিতে পাইতেন। একটি শিশুক্রোড়া জননীর মধ্যে তিনি যেন অতীত ও ভবিষ্যতের সমস্ত মানবশিশুর জননীকে দেখিতে