পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮২৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্র প্ৰথম পত্ৰ বিশে সেপ্টেম্বরে আমরা ‘পুনা' স্টীমারে উঠলেম । পাচটার সময় জাহাজ ছেড়ে দিলে । আমরা তখন জাহাজের ছাতে দাড়িয়ে । আস্তে আস্তে আমাদের চোখের সামনে ভারতবর্ষের শেষ তটরেখা মিলিয়ে গেল । চার দিকের লোকের কোলাহল সইতে না পেরে আমি আমার নিজের ঘরে গিয়ে শুয়ে পড়লেম । গোপন করবার বিশেষ প্রয়োজন দেখছি নে, আমার মনটা বড়োই কেমন নিজীব, অবসন্ন, ত্ৰিয়মাণ হয়ে পড়েছিল, কিন্তু দূর হােক গে— ও-সব করুণরসাত্মক কথা লেখবার অবসরও নেই ইচ্ছেও নেই ; আর লিখলেও হয় তোমার চোখের জল থাকবে না, নয় তোমার ধৈর্য থাকবে না । সমুদ্রের পায়ে দণ্ডবৎ। । ২০শে থেকে ২৬শে পর্যন্ত যে করে কাটিয়েছি তা আমিই জানি । সমুদ্রপীড়া কাকে বলে অবিশ্যি জােন কিন্তু কী রকম তা জান না। আমি সেই ব্যামোয় পড়েছিলেম, সে কথা বিস্তারিত করে লিখলে পাষাণেরও চোখে জল আসবে । ছটা দিন, মশায়, শয্যা থেকে উঠি নি । যে ঘরে থাকতেম, সেটা অতি অন্ধকার, ছোটাে, পাছে সমুদ্রের জল ভিতরে আসে তাই চার দিকের জানলা সম্পূর্ণরূপে বন্ধ। অসূৰ্যাম্পশ্যরূপ ও অবায়ুস্পর্শ্যদেহ হয়ে ছয়টা দিন কেবল বেঁচে ছিলেম মাত্র । প্ৰথম দিন সন্ধেবেলায় আমাদের একজন সহযাত্রী আমাকে জোর করে বিছানা থেকে উঠিয়ে খাবার টেবিলে নিয়ে গেলেন । যখন উঠে দাড়ালেম তখন আমার মাথার ভিতর যা-কিছু আছে সবাই মিলে যেন মারামারি কাটাকাটি আরম্ভ করে দিলে, চোখে দেখতে পাই নে, পা চলে না, সর্বাঙ্গ টলমল করে ! দু-পা গিয়েই একটা বেঞ্চিতে গিয়ে বসে পড়লেম । আমার সহযাত্রীটি আমাকে ধরাধরি করে জাহাজের ডেক-এ নিয়ে গেলেন । একটা রেলের উপর ভর দিয়ে দাড়ালেম । তখন অন্ধকার রাত । আকাশ মেঘে আচ্ছন্ন। আমাদের প্রতিকূলে বাতাস বইছে। সেই অন্ধকারের মধ্যে সেই নিরাশ্রয় অকুল সমুদ্রে দুই দিকে অগ্নি উৎক্ষিপ্ত করতে করতে আমাদের জাহাজ একলা চলেছে ; যেখানে চাই সেই দিকেই অন্ধকার, সমুদ্র ফুলে ফুলে উঠছে- সে এক মহা গভীর দৃশ্য । সেখানে বেশিক্ষণ থাকতে পারলেম না । মাথা ঘুরতে লাগল। ধরাধরি করে আবার আমার ক্যাবিনে এলেম । সেই যে বিছানায় পড়লেম, ছ-দিন আর এক মুহুর্তের জন্যও মাথা তুলি নি । আমাদের যে স্ট্রঅর্ড ছিল (যাত্রীদের সেবক)- কারণ জানি নে— আমার উপর তার বিশেষ কৃপাদৃষ্টি ছিল। দিনের মধ্যে যখন-তখন সে আমার জন্যে খাবার নিয়ে উপস্থিত করত ; না খেলে কোনােমতেই ছাড়ত না । সে বলত, না খেলে আমি ইদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়ব (weak as a rat) । সে বলত, সে আমার জন্যে সব কাজ করতে পারে। আমি তাকে যথেষ্ট সাধুবাদ দিতেম, এবং জাহাজ ছেড়ে আসবার সময় সাধুবাদের চেয়ে আরো কিঞ্চিৎ সারবান পদার্থ দিয়েছিলেম। ছ-দিনের পর আমরা যখন এডেনের কাছাকাছি পৌঁছলেম, তখন সমুদ্র কিছু শান্ত হল । সেদিন আমার সন্ট্রঅর্ড এসে নড়ে চড়ে বেড়াবার জন্যে আমাকে বার বার অনুরোধ করতে লাগল। আমি তার পরামর্শ শুনে বিছানা থেকে তো উঠলেম, উঠে দেখি যে সত্যিই ইদুরের মতো দুর্বল হয়ে পড়েছি। মাথা যেন ধার-করা, কাধের সঙ্গে তার ভালোরকম বনে না ; চুরি-করা কাপড়ের মতো শরীরটা যেন আমার ঠিক গায়ে লাগছে না। ঘর থেকে বেরিয়ে ছাতের উপর গিয়ে একটা কেদারায় হেলান দিয়ে পড়লেম । অনেক দিনের পর বাতাস পেয়ে বঁাচলেম । দুপুরবেলা দেখি একটা ছোটাে নীেকা সেই সমুদ্র দিয়ে চলেছে। চার দিকে অনেক দূর পর্যন্ত আর ডাঙা নেই, জাহাজসুদ্ধ লোক অবাক । তারা আমাদের স্টীমারকে ডাকতে আরম্ভ করলে, জাহাজ থামল । তারা একটি ছোটো নৌকায় করে