পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ Գ ՏՏ r থাকতেম। আমাদের জাহাজে লেডির অভাব ছিল না, কিন্তু জেন্টলম্যানেরা সর্বদা খুঁতখুঁত করতেন যে, তার মধ্যে অল্পবয়স্কা বা সুশ্ৰী একজনও ছিল না । পুরুষ যাত্রীদের মধ্যে অনেকের সঙ্গে আলাপ-পরিচয় হল । ব- মহাশয়ের সঙ্গে আমাদের যথেষ্ট ঘনিষ্ঠতা হয়েছিল । তার কথা অনর্গল, হাসি অজস্ৰ, আহার অপরিমিত । সকলের সঙ্গেই তার আলাপ, সকলের সঙ্গেই তিনি হাসিতামাশা করে বেড়ান। তার একটা গুণ আছে, তিনি কখনো বিবেচনা করে, মেজে ঘষে কথা কন না ; ঠাট্টা করেন, সকল সময়ে তার মানে না থাকুক, তিনি নিজে হেসে আকুল হন । তিনি তার বয়সের ও পদমনের গান্তীর্য বুঝে হিসাব করে কথা কন না, মেপে জুকে হাসেন না ও দু-দিক বজায় রেখে মত প্রকাশ করেন না, এই-সকল কারণে তাকে আমার ভালো লাগত। কত প্রকার যে ছেলেমানুষি করেন তার ঠিক নেই। বৃদ্ধত্বের বুদ্ধি ও বালকত্বের সাদাসিন্দা নিশ্চিন্ত ভাব একত্রে দেখলে আমার বড়ো ভালো লাগে । আমাকে তিনি ‘অবতার বলতেন, গ্রেগরি সাহেবকে ‘গড়গড়ি' বলতেন, আর-এক যাত্রীকে ‘রুহি মৎস্য’ বলে ডাকতেন ; সে-বেচারির অপরাধ কী তা জান ? সাধারণ মানুষদের চেয়ে তার ঘাড়ের দিকটা কিছু খাটাে ছিল, তার মাথা ও শরীরের মধ্যে একটা স্বতন্ত্র যোজক পদার্থ ছিল না বললেও হয়। এইজন্যে ব— মহাশয় তাকে মৎস্যশ্রেণীভুক্ত করেছিলেন । কিন্তু আমি যে কেন অবতার শ্রেণীর মধ্যে পড়ে গিয়েছিলেম, তার কারণ সহজে নির্দেশ করা যায় না । আমাদের জাহাজের T— মহাশয় কিছু নূতন রকমের লোক । তিনি ঘোরতর ফিলজফর মানুষ । তাকে কখনো চলিত ভাষায় কথা কইতে শুনি নি। তিনি কথা কইতেন না, বক্তৃতা দিতেন। একদিন আমরা দু-চার জনে মিলে জাহাজের ছাতে দু-দণ্ড আমোদপ্রমোদ করছিলেম, এমন সময়ে দুৰ্ভাগ্যক্রমে ব—মহাশয় তাকে বললেন “কেমন সুন্দর তারা উঠেছে । এই আমাদের ফিলজফর তারার সঙ্গে মনুষ্যজীবনের সঙ্গে একটা গভীর সম্বন্ধ বাধিয়ে দিয়ে বক্তৃতা শুরু করলেন— আমরা “মূখেতে চাহিয়া থাকে আমাদের জাহাজে একটি আস্ত জনবুল ছিলেন । তার তালবৃক্ষের মতো শরীর, ঝাটার মতো গোফ, শজারুর কঁাটার মতো চুল হাঁড়ির মতো মুখ, মাছের চােখের মতো ম্যাড়মেড়ে চোখ, তাকে দেখলেই আমার গা কেমন করত, আমি পাচ হাত তফাতে সরে যেতেম । এক-এক জন কোনো অপরাধ না করলেও তার মুখশ্ৰী যেন সর্বদা অপরাধ করতে থাকে। প্রত্যহ সকালে উঠেই শুনতে পেতেম। তিনি ইংরেজি, ফ্রেঞ্চ, হিন্দুস্থানি প্রভৃতি যত ভাষা জানেন সমস্ত ভাষায় জাহাজের সমস্ত চাকরিবাকিরদের অজস্র গাল দিতে আরম্ভ করেছেন, ও দশ দিকে দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছেন । তাকে কখনো হাসতে দেখি নি ; কারো সঙ্গে কথা নেই বার্তা নেই, আপনার ক্যাবিনে গো হয়ে বসে আছেন । কোনো কোনো দিন ডেক-এ বেড়াতে আসতেন, বেড়াতে বেড়াতে যার দিকে একবার কৃপাকটাক্ষে নেত্রপাত করতেন, তাকে যেন পিপড়াটির মতো মনে করতেন । প্রত্যহ খাবার সময় ঠিক আমার পাশেই B— বসতেন । তিনি একটি ইয়ুরাশীয় । কিন্তু তিনি ইংরেজের মতো শিস দিতে, পকেটে হাত দিয়ে পা ফাক করে দাড়াতে সম্পূর্ণরূপে শিখেছেন। তিনি আমাকে বড়োই অনুগ্রহের চােখে দেখতেন। একদিন এসে মহাগভীর স্বরে বললেন, “ইয়ং ম্যান, তুমি অক্সফোর্ড যােচ্ছ ? অক্সফোর্ড য়ুনিভার্সিটি বড়ো ভালো বিদ্যালয় ।” আমি একদিন ট্রেঞ্চ সাহেবের Proverbs and their Lessons বইখানি পড়ছিলেম, তিনি এসে বইটি নিয়ে শিস দিতে দিতে দু-চার পাতা উলটিয়ে পালটিয়ে বললেন, “হা, ভালো বই বটে।” এডেন থেকে সুয়েজ যেতে দিন পাচেক লেগেছিল। যারা ব্রিন্দিসি-পথ দিয়ে ইংলন্ডে যায়। তাদের জাহাজ থেকে নেবে সুয়েজে রেলওয়ের গাড়িতে উঠে আলেকজান্দ্ৰিয়াতে যেতে হয় ; আলেকজান্দ্ৰিয়ার বন্দরে তাদের জন্যে একটা স্টীমার অপেক্ষা করে- সেই স্টীমারে চড়ে ভূমধ্যসাগর পার হয়ে ইটালিতে পৌঁছতে হয় । আমরা overland ডাঙা-পেরোনো যাত্রী, সুতরাং আমাদের সুয়েজে নাবিতে হল । আমরা তিন জন বাঙালি ও একজন ইংরেজ একখানি আরব নৌকা ভাড়া ·