পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ brの○ পারলেম না, সেখান থেকে বেরিয়ে খুব ঘাম হতে লাগল। তার পরে এক জায়গায় নিয়ে গিয়ে আমাকে শুইয়ে দিলে । ভীমকায় এক ব্যক্তি এসে আমার সর্বাঙ্গ ডালতে লাগিল । তার সর্বাঙ্গ খোলা, এমন মাংসপেশল চমৎকার শরীর কখনো দেখি নি। “বঢ়োরস্কো বৃষস্কন্ধঃ শালপ্ৰাংশুর্মহাভুজঃ।” মনে মনে ভাবলেম ক্ষীণকায় এই মশকটিকে দালন করার জন্যে এমন প্ৰকাণ্ড কমানের কোনো আবশ্যক ছিল না । সে আমাকে দেখে বললে, আমার শরীর বেশ লম্বা আছে, এখন পাশের দিকে বাড়লে আমি একজন সুপুরুষের মধ্যে গণ্য হব ; আধা ঘণ্টা ধরে সে আমার সর্বাঙ্গ অবিশ্রান্ত দলন করলে, ভূমিষ্ঠকাল থেকে যত খুলো মেখেছি, শরীর থেকে সব যেন উঠে গেল। যথেষ্টরূপে দলিত করে আমাকে আর-একটি ঘরে নিয়ে গেল, সেখানে গরম জল দিয়ে, সাবান দিয়ে, স্পঞ্জ দিয়ে শরীরটা বিলক্ষণ করে পরিষ্কার করলে । পরিষ্করণ-পর্ব শেষ হলে আর-একটা ঘরে নিয়ে গেল । সেখানে একটা বড়ো পিচকিরি করে গায়ে গরম জল ঢালতে লাগল, হঠাৎ গরম জল দেওয়া বন্ধ করে বরফের মতো ঠাণ্ডা জল বর্ষণ করতে লাগল ; এইরকম কখনো গরম কখনো ঠাণ্ডা জলে স্নান করে একটা জলযান্ত্রের মধ্যে গেলেম, তার উপর থেকে নীচে থেকে চার পাশ থেকে বাণের মতো জল গায়ে বিধতে থাকে । সেই বরফের মতো ঠাণ্ডা বরুণ-বাণ-বর্ষণের মধ্যে খানিকক্ষণ থেকে আমার বুকের রক্ত পর্যন্ত যেন জমাট হয়ে গেলা- রণে ভঙ্গ দিতে হল, হাপাতে হাপাতে বেরিয়ে এলেম । তার পরে এক জায়গায় পুকুরের মতো আছে, আমি সীতার দিতে রাজি আছি কি না জিজ্ঞাসা করলে । আমি সাতার দিলেম না, আমার সঙ্গী সীতার দিলেন। তার সাতার দেওয়া দেখে তারা বলাবলি করতে লাগল, “দেখো, দেখো, এরা কী অদ্ভুত রকম করে সাতার দেয়, ঠিক কুকুরের মতো।” এতক্ষণে স্নান শেষ হল। আমি দেখলেম টার্কিশ-বাথে স্নান করা আর শরীরটাকে ধোপার বাড়ি দেওয়া এক কথা । তার পরে সমস্ত দিনের জন্যে এক পাউন্ড দিয়ে এক গাড়ি ভাড়া করা গেল। প্যারিস একসিবিশনি দেখতে গেলেম । তুমি এইবার হয়তো খুব আগ্রহের সঙ্গে কান খাড়া করেছ, ভাবিছ আমি প্যারিস একসিবিশনের বিষয় কী না জানি বর্ণনা করব । কিন্তু দুঃখের বিষয় কী বলব, কলকাতার য়ুনিভার্সিটিতে বিদ্যা শেখার মতো প্যারিস একসিবিশনের সমস্ত দেখেছি কিন্তু কিছুই ভালো করে দেখি নি। একদিনের বেশি আমাদের প্যারিসে থাকা হল না— সে বৃহৎ কাণ্ড একদিনে দেখা কারো সাধ্য নয় । সমস্ত দিন আমরা দেখলেম— কিন্তু সেরকম দেখায়, দেখবার একটা তৃষ্ণা জন্মাল কিন্তু দেখা হল না । সে একটা নগরবিশেষ । এক মাস থাকলে তবে তা বর্ণনা করবার দুরাশা করতেম। প্যারিস একসিবিশনের একটা স্তুপাকার ভাব মনে আছে, কিন্তু শৃঙ্খলাবদ্ধ ভাব কিছুই মনে নেই। সাধারণত মনে আছে যে চিত্রশালায় গিয়ে অসংখ্য অসংখ্য চমৎকার ছবি দেখেছি, স্থাপত্যশালায় গিয়ে অসংখ্য অসংখ্য প্রস্তরমূর্তি দেখেছি, নানা দেশবিদেশের নানা জিনিস দেখেছি ; কিন্তু বিশেষ কিছু মনে নেই। তার পর প্যারিস থেকে লন্ডনে এলেম— এমন বিষগ্ন অন্ধকার পুরী আর কখনো দেখি নি— ধোয়া, মেঘ, বৃষ্টি, কুয়াশা, কাদা আর লোকজনের ব্যস্তসমস্ত ভাব । আমি দুই-এক ঘণ্টামাত্র লন্ডনে ছিলেম, যখন লন্ডন পরিত্যাগ করলেম তখন নিশ্বাস পরিত্যাগ করে বঁাচলেম । আমার বন্ধুরা আমাকে বললেন, লন্ডনের সঙ্গে প্রথম-দৃষ্টিতেই ভালোবাসা হয় না, কিছুদিন থেকে তাকে ভালো করে চিনলে তবে লন্ডনের মাধুর্য বোঝা যায় । দ্বিতীয় পত্ৰ ইংলন্ডে আসবার আগে আমি নির্বোধের মতো আশা করেছিলেম যে, এই ক্ষুদ্র দ্বীপের দুই কার্লাইলের গভীর চিন্তা, বেনের দর্শনশাস্ত্ৰে মুখরিত । সৌভাগ্যক্রমে তাতে আমি নিরাশ হয়েছি। মেয়েরা বেশভূষায় লিপ্ত, পুরুষেরা কাজকর্ম করছে, সংসার যেমন চলে থাকে তেমনি চলছে, কেবল রাজনৈতিক বিষয় নিয়ে বিশেষভাবে কোলাহল শোনা যায় । মেয়েরা জিজ্ঞাসা করে থাকে, তুমি নাচে