পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৫

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

bro8 রবীন্দ্র-রচনাবলী গিয়েছিলে কি না, কনসার্ট কেমন লাগল, থিয়েটারে একজন নুতন অ্যাকটর এসেছে, কাল অমুক জায়গায় ব্যান্ড হবে ইত্যাদি । পুরুষেরা বলবে, আফগান যুদ্ধের বিষয় তুমি কী বিবেচনা কর, Marquis of Lorneাকে লন্ডনীয়েরা খুব সমাদর করেছিল, আজ দিন বেশ ভালো, কালকের দিন বড়ো মিজারেবল ছিল। এ দেশের মেয়েরা পিয়ানো বাজায়, গান গায়, আগুনের ধারে আগুন পোয়ায়, সোফায় ঠেসান দিয়ে নভেল পড়ে, ভিজিটরদের সঙ্গে আলাপচারি করে ও আবশ্যক বা ای মতে যুবকদের সঙ্গে ফ্লার্ট করে । এ দেশের চির-আইবুড়ো মেয়েরা কাজের লোক । টেমপারেন্স মীটিং, ওয়ার্কিং মেনস সোসাইটি প্রভৃতি যতপ্রকার অনুষ্ঠানের কোলাহল আছে, সমুদয়ের মধ্যে তাদের কণ্ঠ আছে । পুরুষদের মতো তাদের আপিসে যেতে হয় না, মেয়েদের মতো ছেলেপিলে মানুষ করতে হয় না, এ দিকে হয়তো এত বয়স হয়েছে যে “বলে’ গিয়ে নাচা বা ফ্লাট করে সময় কাটানো সংগত হয় না, তাই তারা অনেক কাজ করতে পারেন, তাতে উপকারও হয়তো আছে। এখানে দ্বারে দ্বারে মদের দোকান। আমি রাস্তায় বেরলে জুতোর দোকান, দরজির দোকান, ংসের দোকান, খেলনার দোকান পদে পদে দেখতে পাই কিন্তু বইয়ের দোকান প্ৰায় দেখতে পাই নে । আমাদের একটি কবিতার বই কেনবার আবশ্যক হয়েছিল, কিন্তু কাছাকাছির মধ্যে বইয়ের দোকান না দেখে একজন খেলনাওয়ালাকে সেই বই আনিয়ে দিতে হুকুম করতে হয়েছিল— আমি আগে জানতেম, এ দেশে একটা কসাইয়ের দোকান যেমন প্রচুর রূপে দরকারি, বইয়ের দোকানও তেমনি । ইংলন্ডে এলে সকলের চেয়ে চোখে পড়ে লোকের ব্যস্ততা । রাস্তা দিয়ে যারা চলে তাদের মুখ দেখতে মজা আছে— বগলে ছাতি নিয়ে হুস হুস করে চলেছে, পাশের লোকদের উপর ভূক্ষেপ নেই, মুখে যেন মহা উদবেগ, সময় তাদের ফাকি দিয়ে না পালায় এই তাদের প্রাণপণ চেষ্টা । সমস্ত লন্ডনময় রেলোয়ে । প্ৰতি পাচ মিনিট অন্তর এক-একটা ট্রেন যাচ্ছে । লন্ডন থেকে ব্ৰাইটনে আসবার সময় দেখি প্রতি মুহুর্তে উপর দিয়ে একটা, নীচে দিয়ে একটা, পাশ দিয়ে একটা, এমন চারি দিক থেকে হুস হাস করে ট্রেন ছুটেছে। সে ট্রেনগুলোর চেহারা লন্ডনের লোকদেরই মতো, এ দিক থেকে ও দিক থেকে মহা ব্যস্তভাবে হাসফাস করতে করতে চলেছে। দেশ তো এই এক রাত্তি, দু-পা চললেই ভয় হয় পাছে সমুদ্রে গিয়ে পড়ি, এখানে এত ট্রেন যে কেন ভেবে পাই নে । আমরা একবার লন্ডনে যাবার সময় দৈবাৎ ট্রেন মিস করেছিলেম, কিন্তু তার জন্যে বাড়ি ফিরে আসতে হয় নি, তার আধা ঘণ্টা পরেই আর-এক ট্রেন এসে হাজির । এ দেশের লোক প্রকৃতির আদুরে ছেলে নয়, কারুর নাকে তেল দিয়ে তাকিয়া ঠেসান দিয়ে বসে থাকবার জো নেই। একে তো আমাদের দেশের মতো এ দেশের জমিতে আঁচড় কাটলেই শস্য হয় না, তাতে শীতের সঙ্গে মারামারি করতে হয়— প্রথমত শীতের উপদ্রবে। এদের কত কাপড় দরকার হয় তার ঠিক নেই, তার পরে কম খেলে এ দেশে বাঁচবার জো নেই, শরীরে তাপ জন্মাবার জন্যে অনেক খাওয়া চাই । এ দেশের লোকের কাপড়, কয়লা, খাওয়া অপৰ্যাপ্ত পরিমাণে না থাকলে চলে না, তার উপরে আবার মন্দ আছে । আমাদের বাংলার খাওয়া নামমাত্র, কাপড় পরাও তাই । এ দেশে যার ক্ষমতা আছে সেই মাথা তুলতে পারে, দুর্বল লোকদের এখানে রক্ষা নেই— একে প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ, তাতে কার্যক্ষেত্রে সহস্ৰ প্ৰতিদ্বন্দ্বিতা রোখারুখি করছে । ক্ৰমে ক্রমে এখানকার দুই-একজন লোকের সঙ্গে আমার আলাপ হতে চলল। একটা মজা দেখছি, এখানকার লোকেরা আমাকে নিতান্ত অবুঝের মতো মনে করে । একদিন Dr— এর ভাইয়ের সঙ্গে রাস্তায় বেরিয়েছিলেম । একটা দোকানের সম্মুখে কতকগুলো ফোটােগ্রাফ ছিল, সে আমাকে সেইখানে নিয়ে গিয়ে ফোটােগ্রাফের ব্যাখ্যান আরম্ভ করে দিলে- আমাকে বুঝিয়ে দিলে যে, একরকম যন্ত্র দিয়ে ঐ ছবিগুলো তৈরি হয়, মানুষে হাতে করে আঁকে না । আমার চার দিকে লোক দাড়িয়ে গেল। একটা ঘডির দোকানের সামনে নিয়ে, ঘড়িটা যে খুব আশ্চর্য যন্ত্র তাই আমার মনে সংস্কার জন্মাবার জন্যে চেষ্টা করতে লাগল। একটা ঈভনিং পাটিতে মিস- আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আমি এর পূর্বে