পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

brOV2 রবীন্দ্র-রচনাবলী নিমন্ত্রণসভায় গৃহকর্তার বড়ো উচু পদ নেই, তিনি সভায় উপস্থিত থাকুন বা শয়নগৃহে নিদ্রা দিন, তাতে কারও বড়ো কিছু এসে যায় না। আমরা ঘরে প্রবেশ করলেম, গ্যাসের আলোয় ঘর উজ্জ্বল, শত শত রমণীর রূপের আলোকে গ্যাসের আলো ম্রিয়মাণ ; রূপের উৎসব পড়ে গিয়েছে, ঘরের ভিতরে প্রবেশ করবামাত্রই চোখে ধাধা লেগে যায় । ঘরের একপাশে পিয়ানো, বেহালা, বাশি বাজছে, ঘরের চারি ঝকমক করছে। নাচবার ঘরের মেজে কাঠের, তার উপর কাপেট প্রভৃতি কিছু পাতা নেই, সে কাঠের মেজে এমন পালিশ করা যে, পা পিছলে যায়। ঘর যত পিছল হয় ততই নাচবার উপযুক্ত হয়, কেননা পিছল। ঘরে নাচের গতি সহজ হয়, পা কোনো বাধা পায় না, আপনা-আপনি পিছলে আসে ।। ঘরের চারি দিকে আশেপাশে যে-সকল বারান্দার মতো আছে, তাই একটু ঢেকেঢুকে, গাছপালা দিয়ে, দু-একটি কোচ চৌকি রেখে তাকে প্রণয়ীদের কুঞ্জ নামে অভিহিত করা হয়েছে। সেইখানে নাচে শ্রান্ত হয়ে বা কোলাহলে বিরক্ত হয়ে যুবকযুবতী নিরিবিলি মধুরালাপে মগ্ন থাকতে পারেন। ঘরে ঢোকবার সময় সকলের হাতে সোনার অক্ষরে ছাপা এক-একখানি কাগজ দেওয়া হয়, সেই কাগজে কী কী নাচ হবে তাই লেখা থাকে । ইংরেজি নােচ দুই শ্রেণীতে ভাগ করা যায়, এক রকম হচ্ছে স্ত্রী পুরুষে মিলে রে ঘুরে নাচা, তাতে কেবল দুজন লোক একসঙ্গে নাচে ; আর-একরকম নাচে চারটি জুড়ি নর্তকনাতকী চতুষ্কোণ হয়ে সুমুখাসুমুখি দাড়ায় ও হাতধরাধরি করে নানা ভঙ্গিতে চলাফেরা করে বেড়ায়, কোনো কোনো সময় চার জুড়ি না হয়ে আট জুড়িও হয় । ঘুরে ঘুরে নাচকে রাউন্ড ডান্স বলে ও চলাফেরা করে নাচার নাম স্কোয়্যার ডান্স। নাচ আরম্ভ হবার পূর্বে গৃহকত্রী মহিলা ও পুরুষদের মধ্যে আলাপ করিয়ে দেন অর্থাৎ পুরুষ-অভ্যাগতকে সঙ্গে করে কোনো এক অভ্যাগত-মহিলার কাছে নিয়ে গিয়ে বলেন, “মিস আমুক, ইনি মিস্টার অমুক।” আমনি মিস ও মিস্টার শিরঃকম্পন করেন । কোনো মিসের সঙ্গে পরিচয় হবার পর নাচবার ইচ্ছে করলে পকেট থেকে সেই সোনার জলে ছাপানো প্রোগ্রামটি বের করে তাকে জিজ্ঞাসা করতে হয়, “আপনি কি অমুক নৃত্যে বাগদত্তা হয়ে আছেন ?” তিনি যদি না’ বলেন তা হলে তাকে বলতে হবে, “তবে আমি কি আপনার সঙ্গে নাচবার সুখভোগ করতে পারি ?” তিনি ‘থ্যাঙ্ক য়ু বললে বোঝা যাবে কপালে তার সঙ্গে নাচবার সুখ আছে। আমনি সেই কাগজটিতে সেই নাচের পাশে তার নাম এবং তার কাগজে আবেদনকারীর নাম লিখে দিতে হয় । নাচ আরম্ভ হল । ঘুর-ফুর-ফুর । একটা ঘরে, মনে করো, চল্লিশ-পঞ্চাশ জুড়ি নাচছে ; ঘেঁষাৰ্ঘেষি, ঠেলা ঠেলি, কখনো বা জুড়িতে জুড়িতে ধাক্কাধাব্ধি । তবু ঘুর-ফুর-ফুর । তালে তালে বাজনা বাজছে, তালে তালে পা পড়ছে, ঘর গরম হয়ে উঠেছে। একটা নাচ শেষ হল, বাজনা থেমে গেল ; নর্তক মহাশয় তার শ্রান্ত সহচরীকে আহারের ঘরে নিয়ে গেলেন, সেখানে টেবিলের উপর ফলমূল মিষ্টান্ন মন্দিরার আয়োজন ; হয়তো আহার-পান করলেন নাহয় দুজনে নিভৃত কুঞ্জে বসে রহস্যালাপ করতে লাগলেন । আমি নতুন লোকের সঙ্গে বড়ো মিলে মিশে নিতে পারি নে, যে-নচে আমি একেবারে সুপণ্ডিত, সে-নাচেও নতুন লোকের সঙ্গে নাচতে পারি নে। সত্যি কথা বলতে কি, নাচের নেমন্তস্নগুলো আমার বড়ো ভালো লাগে না । যাদের সঙ্গে বিশেষ আলাপ আছে, তাদের সঙ্গে নাচতে মন্দ লাগে না । যেমন তাস খেলবার সময় খারাপ জুড়ি পেলে তার পরে তার দলের লোক চটে যায়, তেমনি নাচের সময় খারাপ জুড়ির পরে মেয়েরা ভারি চটে যায়। আমার নাচের সহচরী বোধ হয় নাচার সময় মনে মনে আমার মরণ কামনা করেছিলেন । নাচ ফুরিয়ে গেল, আমি হঁপ ছেড়ে বঁাচলেম, তিনিও নিস্তার পেলেন । প্রথমে নাচের ঘরে ঢুকেই আমি একেবারে চমকে উঠেছিলেম, দেখি যে শত শ্বেতাঙ্গিনীদের মধ্যে আমাদের একটি ভারতবষীয়া শ্যামাঙ্গিনী রয়েছেন । দেখেই তো আমার বুকটা একেবারে নোচে উঠেছিল । তার সঙ্গে কোনোমতে আলাপ করবার জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেম । কতদিন শ্যামলা মুখ দেখি নি । আর, তার মুখে আমাদের বাঙালি মেয়েদের ভালোমানুষি নম্রভাব মাখানো । আমি অনেক ইংরেজ মেয়েদের মুখে ভালোমানুষ নরম ভাব দেখেছি কিন্তু এর সঙ্গে তার কী একটা তফাত আছে