পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৩৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ レアのa বলতে পারি নে। তার চুল বাধা আমাদের দেশের মতো । সাদা মুখ আর উগ্ৰ অসংকোচ সৌন্দর্য দেখে দেখে আমার মনটা ভিতরে ভিতরে বিরক্ত হয়ে গিয়েছিল, এতদিনে তাই বুঝতে পারলেম । হাজার হােক, ইংরেজ মেয়েরা সম্পূৰ্ণ আলাদা জাত, আমি এতদূর ইংরেজি কায়দা শিখি নি যে, তাদের সঙ্গে বেশ খোলাখুলি ভাবে কথাবার্তা কইতে পারি। পরিচিত বাধি গতের সীমা লঙঘন করতে সাহস হয় না | আজ ব্রাইটনের অনেক তপস্যার ফলে সূর্য উঠেছেন । এ দেশে রবি যেদিন মেঘের অন্তঃপুর থেকে বের হন সেদিন একটি লোকও কেউ ঘরে থাকে না । সেদিন সমুদ্রের ধারে বেড়াবার রাস্তায় লোক কিলবিল করতে থাকে । এ দেশে যদিও ‘বাড়ির ভিতর নেই, তবু এ দেশের মেয়েরা যেমন অসূৰ্য্যাম্পশ্যরূপা এমন আমাদের দেশে নয়। সাড়ে আটটার কমে আমাদের বিছানা থেকে ওঠা হয় না, ছ-টার সময় বিছানা থেকে উঠলে এখানকার লোকেরা আশ্চর্য হয় । তার পরে উঠেই আমি রোজ ঠাণ্ডা জলে স্নান করি । এ দেশে যাকে স্নান বলে, আমি সেরকম সুমানের বিড়ম্বনা করি নে । আমি মাথায় জল ঢেলে স্নান করি, গরম জল নয়— এখানকার এই বরফের মতো ঠাণ্ডা জল ৷ ন-টার সময় আমাদের খাবার আসে । এখানকার ন-টা আর সেখানকার ছ-টা সমান | আমাদের আর-একটি খাওয়া দেড়টার সময়, সেইটিই প্ৰধান খাওয়া— মধ্যাহ্নভোজন | মধ্যে একবার চা রুটি প্রভৃতি আসে, তার পরে রাত আটটার সময় আর-একটি সুপ্ৰশস্ত ভোজনের আয়োজন হয়ে থাকে, এইরকম আমাদের দিনের প্রধান বিভাগগুলি খাওয়া নিয়ে । , অন্ধকার হয়ে আসছে, চারটে বাজে বলে, চারটে বাজলে পরে আলো না জেলে পড়া দুষ্কর । এখানে প্রকৃতপক্ষে ন-টার সময় দিন আরম্ভ হয়, কেননা গড়ে রোজ আটটার কমে ওঠা হয় না । তার পর আবার বৈকাল চারটের সময়েই এখানকার দিনের আলো নিভে যায় । দিনগুলো যেন দশটা চারটে আপিস করতে আসে। ট্যাক-ঘড়ির ডালা খুলতে খুলতেই এ দেশে দিন চলে যায় । এখানকার রাত্তির মেঘ, বৃষ্টি, বাদল, অন্ধকার, শীত— এ আর একাদণ্ডের তরে ছাড়া নেই। আমাদের দেশে যখন বৃষ্টি হয় তখন মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ, মেঘ, বীজ, বিদ্যুৎ, ঝড়— তাতে একটা কেমন উল্লাসের ভাব আছে ; এখানে এ তা নয়, এ টিপ টিপ করে সেই একঘেয়ে বৃষ্টি ক্রমাগতই অতিনিঃশব্দ পদসঞ্চারে চলছে তো চলছেই । রাস্তায় কাদা, পত্ৰহীন গাছগুলো স্তব্ধভাবেই দাড়িয়ে দাড়িয়ে ভিজছে, কঁাচের জানলার উপর টিপ টিপ করে জল ছিটিয়ে পড়ছে । আমাদের দেশে স্তরে স্তরে মেঘ করে ; এখানে আকাশ সমতল, মনে হয় না যে মেঘ করেছে, মনে হয় কোনো কারণে আকাশের রঙটা ঘুলিয়ে গিয়েছে, সমস্তটা জড়িয়ে স্থাবরজঙ্গমের একটা অবসন্ন মুখশ্ৰী । লোকের মুখে সময়ে সময়ে শুনতে পাই বটে যে, কাল বজ ডেকেছিল, কিন্তু বজের নিজের এমন গলার জোর নেই যে তার মুখ থেকেই সে খবরটা পাই । সূর্য তো এখানে গুজবের মধ্যে হয়ে পড়েছে। যদি অনেক ভাগ্যবলে সকালে উঠে সূর্যের মুখ দেখতে পাই, তবে তখনই আবার মনে হয় এমন দিন না। রবে, তা জানো | দিনে দিনে শীত খুব ঘনিয়ে আসছে ; লোকে বলছে, কাল-পরশুর মধ্যে হয়তো আমরা বরফ পড়া দেখতে পাব । তাপমান যন্ত্র ত্ৰিশ ডিগ্রি পর্যন্ত নেবে গিয়েছে— সেই তো হচ্ছে ফ্রজিং পয়েন্ট । অল্পস্বল্প ফ্রস্ট দেখা দিয়েছে। রাস্তার মাটি খুব শক্ত । কেননা তার মধ্যে যা জল ছিল সমস্ত জমাট হয়ে গিয়েছে। রাস্তার মাঝে মাঝে র্কাচের টুকরোর মতো শিশির খুব শক্ত হয়ে জমেছে। দুই-এক জায়গায় ঘাসের মধ্যে কে যেন চুন ছড়িয়ে দিয়েছে, বরফের এই প্রথম সূত্রপাত । খুব শীত পড়েছে, এক-এক সময়ে হাত-পা এমন ঠাণ্ডা হয়ে যায় যে জ্বালা করতে থাকে । সকালে লেপ থেকে বেরোতে ভাবনা হয় । আমাদের দিশি কাপড় দেখে রাস্তার এক-একজন সত্যি সত্যি হেসে ওঠে, এক-একজন এত আশ্চর্য