পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪০

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ brのぬ আসন গ্রহণ করলেন। কাজ আরম্ভ হল। হাউসের প্রথম কাজ প্রশ্নোত্তর করা। হাউসের পূর্ব অধিবেশনে এক-একজন মেম্বার বলে রাখেন যে, “আগামী বারে আমি অমুক অমুক বিষয়ে প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করব, তার উত্তর দিতে হবে ।” সেদিন ও'ডোনেল নামে একজন আইরিশ মেম্বার জিজ্ঞাসা করলেন যে, “একো এবং আরো দুই-একটি খবরের কাগজে জুলুদের প্রতি ইংরেজ সৈন্যদের অত্যাচারের যে বিবরণ বেরিয়েছে, সে বিষয়ে গভর্নমেন্ট কি কোনো সংবাদ পেয়েছেন ? আর সে-সকল অত্যাচার কি খ্ৰীস্টানদের অনুচিত নয় ?” অমনি গভর্নমেন্টের দিক থেকে সার মাইকেল হিকসবিচ উঠে ও'ডোনেলকে কড়া কড়া দুই-এক কথা শুনিয়ে দিলেন, আমনি একে একে যত আইরিশ মেম্বার ছিলেন, সকলে উঠে তার কড়া কড়া উত্তর দিতে লাগলেন । এইরকম অনেকক্ষণ ঝগড়াঝাটি করে দুই পক্ষ শান্ত হয়ে বসলেন । উত্তর-প্রত্যুত্তরের ব্যাপার সমাপ্ত হলে পর যখন বক্তৃতা করবার সময় এল, তখন হাউস থেকে অধিকাংশ মেম্বার উঠে চলে গেলেন । দুই-একটা বক্তৃতার পর ব্ৰাইট উঠে সিভিল সার্ভিসের রাশি রাশি দরখাস্ত হাউসে দাখিল করলেন । বৃদ্ধ ব্ৰাইটকে দেখলে অত্যন্ত ভক্তি হয়, তীর মুখে ঔদার্য ও দয়া যেন মাখানো ৷ দুৰ্ভাগ্যক্রমে ব্ৰাইট সেদিন কিছু বক্তৃতা করলেন না। হাউসে অতি অল্প মেম্বারই অবশিষ্ট ছিলেন, র্যারা ছিলেন তাদের মধ্যে অনেকেই নিদ্রার আয়োজন করছিলেন, এমন সময় গ্র্যাডস্টোন উঠলেন । গ্ল্যাডস্টোন ওঠবামাত্র সমস্ত ঘর একেবারে নিস্তব্ধ হয়ে গেল, গ্র্যাডস্টোনের স্বর শুনতে পেয়ে আস্তে আস্তে বাইরে থেকে দলে দলে মেম্বার আসতে লাগলেন, দুই দিকের বেঞ্চি পুরে গেল । তখন পূর্ণ উৎসের মতো গ্র্যাডস্টোনের বক্তৃতা উৎসারিত হতে লাগল। কিছুমাত্র চীৎকার, তর্জনগর্জন ছিল না, অথচ তার প্রতি কথা, ঘরের যেখানে যে-কোনো লোক বসেছিল, সকলেই একেবারে স্পষ্ট শুনতে পাচ্ছিল । গ্ল্যাডস্টোনের কী একরকম দৃঢ়স্বরে বলবার ধরন আছে, তার প্রতি কথা মনের ভিতর গিয়ে যেন জোর করে বিশ্বাস জন্মিয়ে দেয় । একটা কথায় জোর দেবার সময় তিনি মুষ্টি বদ্ধ করে একেবারে নুয়ে নুয়ে পড়েন, যেন প্রত্যেক কথা তিনি একেবারে নিংড়ে নিংড়ে বের করছেন। আর সেইরকম প্রতি জোর-দেওয়া কথা দরজা ভেঙে-চুরে যেন মনের ভিতর প্ৰবেশ করে । গ্র্যাডস্টোন অনগল বলেন বটে কিন্তু তার প্রতি কথা ওজন করা, তার কোনো অংশ অসম্পূর্ণ নয় ; তিনি বক্তৃতার প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত সমস্বরে জোর দিয়ে বললেন না, কেননা সে-রকম বলপূর্বক বললে স্বভাবতই শ্রোতাদের মন তার বিরুদ্ধে কোমর বেঁধে দাঁড়ায় । তিনি যে-কথায় জোর দেওয়া আবশ্যক মনে করেন, সেই কথাতেই জোর দেন ; তিনি খুব তেজের সঙ্গে বলেন বটে। কিন্তু চীৎকার করে বলেন না, মনে হয় যা বলছেন, তাতে তার নিজের খুব আন্তরিক বিশ্বাস । গ্র্যাডস্টোনের বক্তৃতাও যেমন থামল, অমনি হাউস। শূন্যপ্রায় হয়ে গেল, দু দিকের বেঞ্চিতে ছ-সাতজনের বেশি আর লোক ছিল না । গ্ল্যাডস্টোনের পর স্মলেট যখন বক্তৃতা আরম্ভ করলেন তখন দুই দিককার বেঞ্চিতে লোক ছিল না বললেও হয় ; কিন্তু তিনি ক্ষান্ত হবার পাত্র নন, শূন্য হাউসকে । সম্বোধন করে অত্যন্ত দীর্ঘ এক বক্তৃতা করলেন। সেই অবকাশে আমি অত্যন্ত দীর্ঘ এক নিদ্রা দিই। : দুই-একজন মেম্বার, যারা উপস্থিত ছিলেন, তারা কেউ বা পরস্পর গল্প করছিলেন, কেউ বা চােখের উপর টুপি টেনে দিয়ে ডিসরেলির পদচ্যুতির পর রাজ্যের প্রধান মন্ত্রী হবার স্বপ্ন দেখছিলেন । হাউসে আইরিশ মেম্বারদের ভারি মুশকিল ; তারা যখন বক্তৃতা করতে ওঠেন, তখন চার দিক বিদ্রুপাত্মক “হিয়ার” “হিয়ার” শব্দে বক্তার স্বর ডুবে যায়। এইরকম বাধা পেয়ে বক্তা আর আত্মসংবরণ করতে পারেন না, খুব জ্বলে ওঠেন, আর তিনি যতই রাগ করতে থাকেন ততই হাস্যাম্পদ হন । আইরিশ মেম্বারেরা এইরকম জ্বালাতন হয়ে আজকাল শোধ তুলতে আরম্ভ করেছেন । হাউসে যে-কোনো কথা ওঠে, প্ৰায় সকল বিষয়েই তারা বাধা দেন, আর প্রতি প্ৰস্তাবে একজনের পর আর-একজন করে উঠে। দীর্ঘকালব্যাপী বক্তৃতায় হাউসকে বিব্রত করে তোলেন।