পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪২

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ । br>> রেখেছিলেন । ঘরে ঢুকে দেখেন, ঘরে কাপেট পাতা, দেয়ালে ছবি টাঙানো, একটা বড়ো আয়না এক জায়গায় ঝোলানো, কোঁচ, কতকগুলি চৌকি, দুই-একটা বঁকাচের ফুলদানি, এক পাশে একটি ছোটাে পিয়ানো। কী সর্বনাশ ! তাদের বন্ধুদের ডেকে বললেন, “আমরা কি এখানে বড়োমানুষি করতে এসেছি ? আমাদের বাপু বেশি টাকাকড়ি নেই, এরকম ঘরে থাকা আমাদের পোষাবে না।” বন্ধুরা অত্যন্ত আমোদ পেলেন, কারণ তখন তারা একেবারে ভুলে গেছেন যে বহুপূর্বে তাদেরও একদিন এইরকম দশা ঘটেছিল । নবাগতদের নিতান্ত অন্নজীবী বাঙালি মনে করে অত্যন্ত বিজ্ঞতার স্বরে বললেন, “এখানকার সকল ঘরই এইরকম !” নবাগত ভাবলেন, আমাদের দেশে সেই একটা সঁ্যাতসেঁতে ঘরে একটা তক্তা ও তার উপরে একটা মাদুর পাতা, ইতস্তত হঁকোর বৈঠক, কোমরে একটুখানি কাপড় জড়িয়ে জুতো জোড়া খুলে দু-চারজন মিলে শতরঞ্চি খেলা চলছে, বাড়ির উঠোনে একটা গোরু বাধা, দেয়ালে গোবর দেওয়া, বারান্দা থেকে ভিজে কাপড় শুকোচ্ছে ইত্যাদি । তারা বলেন, প্ৰথম প্ৰথম দিনকতক চৌকিতে বসতে, কোচে শুতে, টেবিলে খেতে, কাপেটে বিচরণ করতে অত্যন্ত সংকোচ বোধ হত । সোফায় অত্যন্ত আড় হয়ে বসতেন, ভয় হত, পাছে সোফা ময়লা হয়ে যায় বা তার কোনোপ্রকার হানি হয় । মনে হত, সোফাগুলো কেবল ঘর সাজাবার জন্যেই রেখে দেওয়া, এগুলো ব্যবহার করতে দিয়ে মাটি করা কখনোই ঘরের কর্তার অভিপ্রেত হতে পারে না । ঘরে এসে প্রথম মনের ভাব তো এই, তার পরে আর-একটি প্রধান কথা বলা বাকি । বাড়িতে থাকেন ‘বাড়িওআলী'র সঙ্গেই তাদের সমস্ত সম্পর্ক । ভাড়া চুকিয়ে দেওয়া, কোনোপ্রকার। বোঝাপড়া, আহারাদির বন্দোবস্ত করা, সে সমস্তই বাড়িওআলীর কাছে । আমার বন্ধুরা যখন প্রথম পদাৰ্পণ করলেন, দেখলেন, এক ইংরেজনী এসে অতি বিনীত স্বরে তাদের ‘সুপ্ৰভাত’ অভিবাদন করলে, তারা নিতান্ত শশব্যস্ত হয়ে ভদ্রতার যথাযোগ্য প্রতিদান দিয়ে আড়ষ্ট হয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন । কিন্তু যখন তারা দেখলেন, তাদের অন্যান্য ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুগণ তার সঙ্গে অতি অসংকুচিত স্বরে কথাবার্তা আরম্ভ করে দিলেন, তখন আর তাদের বিস্ময়ের আদি অন্ত রইল না । মনে করো এক সজীব বিবিসিাহেব জুতো-পরা, টুপি-পরা, গাউন-পরা ! তখন ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুদের উপর সেই নবাগত বঙ্গযুবকদের ভক্তির উদয় হল, কোনো কালে যে এই অসমসাহসিকদের মতো তাদেরও বুকের পাটা জন্মাবে, তা তাদের সম্ভব বোধ হল না । যা হােক, এই নবাগতদের যথাস্থানে প্রতিষ্ঠিত করে দিয়ে ইঙ্গবঙ্গ বন্ধুগণ স্ব স্ব আলয়ে গিয়ে সপ্তাহকাল ধরে তাদের অজ্ঞতা নিয়ে অপর্যাপ্ত হাস্যকৌতুক করলেন । পূর্বোক্ত গৃহকত্রী প্রত্যহ নবাগতদের অতি বিনীতভাবে, কী চাই, কী না চাই, জিজ্ঞাসা করতে আসত। তারা বলেন, এই উপলক্ষে তাদের অত্যন্ত আহলাদ হত । তাদের মধ্যে একজন বলেন, প্রথম দিন যেদিন তিনি এই ইংরেজ মেয়েকে একটুখানি ধমকাতে পেরেছিলেন, সেদিন সমস্ত দিন তার মন অত্যন্ত প্ৰফুল্ল ছিল। অথচ সেদিন সূর্য পশ্চিম দিকে ওঠে নি, পর্বত চলাফেরা করে বেড়ায় নি, বহ্নিও শীতলতা প্ৰাপ্ত হয়, নি । কাপেট-মোড়া ঘরে তারা সুখে বাস করছেন । তারা বলেন, “আমাদের দেশে নিজের ঘর বলে একটা স্বতন্ত্র পদার্থ ছিল না ; যে-ঘরে বসতেম, সে-ঘরে বাড়ির দশজনে যাতায়াত করছেই । আমি একপাশে লিখছি, দাদা একপাশে একখানা বই হাতে করে ঢুলছেন, আর-এক দিকে মাদুর পেতে গুরুমশায় ভুলুকে উচ্চৈঃস্বরে সুর করে করে নামতা পড়াচ্ছেন। এখানে আমার নিজের ঘর ; সুবিধামত করে বইগুলি এক দিকে সাজালেম, লেখবার সরঞ্জাম এক দিকে গুছিয়ে রাখলেম, কোনো ভয় নেই যে, একদিন পাচটা ছেলে মিলে সমস্ত ওলট-পালট করে দেবে, আর একদিন দুটাের সময় কলেজ থেকে এসে দেখব, তিনটে বই পাওয়া যাচ্ছে না, অবশেষে অনেক খোজ-খোজ করে দেখা যাবে বইগুলি নিয়ে আমার ছোটাে ভাগ্নিটি তার ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র সহচরীদের ডেকে ছবি দেখতে ঘোরতর ব্যস্ত । এখানে নিজের ঘরে বসে থাকো, দরজাটি ভেজানো, সন্ট করে না বলে কয়ে কেউ ঘরের মধ্যে এসে পড়ে না, ঘরে ঢোকবার আগে দরজায় শব্দ করে, ছেলেপিলেগুলো চারি দিকে চেচামেচি