পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ br>(? অনেক ইঙ্গিবঙ্গ দেখতে পাবে তারা আমার এই বর্ণনার বহির্গত । কিন্তু সাধারণত ইঙ্গবঙ্গত্বের লক্ষণগুলি আমি যতদূর জানি তা লিখেছি। ভারতবর্ষে গিয়ে ইঙ্গবঙ্গদের কী রকম অবস্থা হয় সে-বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতাও নেই, বক্তব্যও নেই। কিন্তু কিছু কাল ভারতবর্ষে থেকে তার পরে ইংলন্ডে এলে কী রকম ভাব হয় তা আমি অনেকের দেখেছি । তাদের ইংলন্ড আর তেমন ভালো লাগে না ; অনেক সময়ে তারা ভেবে পান না, ইংলন্ড বদলেছে, কি তারা বদলেছেন । আগে ইংলন্ডের অতি সামান্য জিনিস ভালো লাগত ; এখন ইংলন্ডের শীত ইংলন্ডের বর্ষ তাদের ভালো লাগছে না, এখন তারা ভারতবর্ষে ফিরে যেতে হলে দুঃখিত হন না । তারা বলেন, আগে তারা ইংলন্ডের স্ট্রবেরি ফল অত্যন্ত ভালোবাসতেন । এমন-কি তারা যতরকম ফল খেয়েছেন তার মধ্যে স্ট্রবেরিই তাদের সকলের চেয়ে স্বাদু মনে হত । কিন্তু এই কয় বৎসরের মধ্যে স্ট্রবেরির স্বাদ বদলে গেল নাকি । এখন দেখছেন তার চেয়ে অনেক দিশি ফল তাদের ভালো লাগে । আগে ডেভনশিয়রের ক্রীম তাদের এত ভালো লগত যে, তার আর কথা নেই, কিন্তু এখন দেখছেন আমাদের দেশের ক্ষীর তার চেয়ে ঢের ভালো । তারা ভারতবর্ষে গিয়ে স্ত্রীপুত্রপরিবার নিয়ে সংসারী হয়ে পড়েন, রোজগার করতে আরম্ভ করেন, ভারতবর্ষের মাটিতে তাদের শিকড় একরকম বসে যায় । মনটা কেমন শিথিল হয়ে আসে, তখন পায়ের উপর পা দিয়ে টানা পাখার বাতাস খেয়ে কোনোপ্রকারে দিন কাটিয়ে দিতে পারলে নিশ্চিন্ত থাকেন । বিলোতে আমোদ বিলাস ভোগ করতে গেলেও অনেক উদ্যমের আবশ্যক করে । এখানে এ-ঘর থেকে ও-ঘরে যেতে হলে গাড়ির চলন নেই, হাত-পা নাড়তে মাসে সাড়ে তিন টাকা নয় । থিয়েটার দেখতে যাও ; সন্ধেবেলা বৃষ্টি পড়ছে, পথে কাদা, একটা ছাতা ঘাড়ে করে মাইল কতক ছুটােছুটি করে তবে ঠিক সময়ে পৌঁছতে পারবে । যখন রক্তের তেজ থাকে তখন এ-সকল পেরে ওঠা যায় । ষষ্ঠ পত্ৰ আমাদের ব্রাইটনের বাড়িটি, সমুদ্রের কাছে একটি নিরালা জায়গায় । এক সার কুড়ি-পঁচিশটি বাড়ি, বাড়িগুলির নাম মেডিনা ভিলাজ । হঠাৎ মনে হয়েছিল বাগানবাড়ি । এখানে এসে দেখি, “ভিলা”ত্বর মধ্যে আমাদের বাড়ির সামনে দু-চার হাত জমিতে দু-চারটে গাছ পোতা আছে। বাড়ির দরজায় একটা লোহার কড়া লাগানো, সেইটোতে ঠক ঠক করলেম, আমাদের ল্যান্ডলেডি এসে দরজা খুলে দিলে । আমাদের দেশের তুলনায় এখানকার ঘরগুলো লম্বা চওড়া ও উচুতে ঢের ছোটাে । চারি দিকে জানলা বন্ধ, একটু বাতাস আসবার জো নেই, কেবল জানলাগুলো সমস্ত কঁাচের বলে আলো আসে। শীতের পক্ষে এরকম ছোটােখাটাে ঘরগুলো ভালো, একটু আগুন জ্বালালেই সমস্ত বেশ গরম হয়ে ওঠে, কিন্তু তা হােক, যেদিন মেঘে চার দিক অন্ধকার, টিপটপ করে বৃষ্টি পড়ছে, তিন-চার দিন ধরে মেঘ-বৃষ্টি-অন্ধকারের এক মুহুর্ত বিরাম নেই, সেদিন এই ছোটাে অন্ধকার ঘরটার এক কোণে বসে আমার মনটা অত্যন্ত বিগড়ে যায়, কোনোমতে সময় কাটে না । খালি আমি বলে নয়, আমার ইংরেজ আলােপীরা বলেন সেরকম দিনে তাদের অত্যন্ত swear করার প্রবৃত্তি জন্মায় (swear করা রোগটা সম্পূর্ণ যুরোপীয়, সুতরাং ওর বাংলা কোনো নাম নেই), মনের ভাবটা অধাৰ্মিক হয়ে ওঠে। যা হােক এখানকার ঘর-দুয়ারগুলি বেশ পরিষ্কার ; বাড়ির ভিতরে প্রবেশ করলে কোথাও ধুলো দেখবার জো নেই, মেজের সর্বাঙ্গ কাপেট প্রভৃতি দিয়ে মোড়া, সিঁড়িগুলি পরিষ্কার তক তক করছে। চোখে দেখতে খারাপ হলে এরা সইতে পারে না । প্ৰতি সামান্য বিষয়ে এদের ভালো দেখতে হওয়াটা প্ৰধান আবশ্যক । শোকবস্ত্ৰও সুশ্ৰী দেখতে হওয়া চাই । আমরা যাকে পরিষ্কার বলি সেটা কিন্তু আর-একটা জিনিস। এখানকার লোকেরা খাবার পরে আঁচায় না, কেননা আঁচানো জল মুখ থেকে পড়ছে সে অতি কুশ্ৰী দেখায়। শ্ৰীহানি হয় বলে পরিষ্কার হওয়া হয় না। এখানে যেরকম কাশি-সর্দির প্রাদুর্ভাব, তাতে