পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৪৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br>br রবীন্দ্র-রচনাবলী তিনি সব চেয়ে বেশি সাজগোজ করে এসেছিলেন, তার দু হাতের দশ আঙুলে যতগুলো ধরে তত আংটি ছিল । আমি যদি নিমন্ত্রণকর্তা হতুম তা হলে তার আংটির বাহুল্য দেখেই বুঝতে পারতুম যে তিনি পিয়ানো বাজাবেন বলে বাড়ি থেকে স্থির সংকল্প হয়ে এসেছেন । তার বাজনা সাঙ্গ হলে পর গৃহকত্রী আমাকে গান গাবার জন্যে অত্যন্ত পীড়াপীড়ি আরম্ভ করলেন । আমি বড়ো মুশকিলে পড়লুম। আমি জানতুম, আমাদের দেশের গানের উপর যে তাদের বড়ো অনুরাগ আছে তা নয় । ভালোমানুষ হবার বিপদ এই যে নিজেকে হাস্যকরীতা থেকে বাচানো যায় না । তাই মিস্টার টি- গান গাওয়ার ভূমিকা স্বরূপ দুই-একটি আরম্ভসূচক কাশি-ধ্বনি করলেন। সভা শান্ত হল । কোনোপ্রকারে কর্তব্য পালন করলুম। সভাস্থ মহিলাদের এত হাসি পেয়েছিল যে, ভদ্রতার বঁাধ টলমল করছিল ; কেউ কেউ হাসিকে কাশির রূপান্তরে পরিণত করলেন, কেউ কেউ হাত থেকে কী যেন পড়ে গেছে। ভান করে ঘাড় নিচু করে হাসি লুকোতে চেষ্টা করলেন, একজন কোনো উপায় না দেখে তার পার্শ্বস্থ সহচরীর পিঠের পিছনে মুখ লুকোলেন, র্যারা কতকটা শান্ত থাকতে পেরেছিলেন তাদের মধ্যে চোখে চােখে টেলিগ্রাফ চলছিল। সেই সংগীতশাস্ত্ৰবিশারদ প্রৌঢ়টির মুখে এমন একটু মৃদু তাচ্ছিল্যের হাসি লেগে ছিল যে, সে দেখে শরীরের রক্ত জল হয়ে আসে । গান যখন সাঙ্গ হল তখন আমার মুখ কান লাল হয়ে উঠেছে, চার দিক থেকে একটা প্ৰশংসার গুঞ্জনধ্বনি উঠল, কিন্তু অত হাসির পর আমি সেটাকে কানে তুললুম না । ছোটাে মিস হ— আমাকে গানটা ইংরেজিতে অনুবাদ করতে অনুরোধ করলেন, আমি অনুবাদ করলেম । গানটা হচ্ছে “প্রেমের কথা আর বোলো না” । তিনি অনুবাদটা শুনে আমাকে জিজ্ঞাসা করলেন, তোমাদের দেশে প্রেমের স্বাধীনতা আছে নাকি । কতকগুলি রোমের ভগ্নাবশেষের ফোটােগ্রাফ ছিল, সেইগুলি নিয়ে গৃহকত্রী কয়েকজন অভ্যাগতকে জড়ো করে দেখাতে লাগলেন । ডাক্তার মা- একটা টেলিফোন কিনে এনেছেন, সেইটে নিয়ে তিনি কতকগুলি লোকের কৌতুহল তৃপ্ত করছেন । পাশের ঘরে টেবিলে খাবার সাজানো । এক-একবার গৃহকর্তা এসে এক-একজন পুরুষের কানে কানে বলে যাচ্ছেন, মিস অথবা মিসেস আমুককে নিশিভোজনে নিয়ে যাও ; তিনি গিয়ে সেই মহিলার কাছে তাকে খাবার ঘরে নিয়ে যাবার অনুমতি প্রার্থনা করছেন ও র্তার বাহুগ্রহণ করে তাকে পাশের ঘরে আহারস্থলে নিয়ে যাচ্ছেন । এরকম সভায় সকলে মিলে একেবারে খেতে যায় না, তার কারণ তা হলে আমোদপ্রমোদের স্রোত অনেকটা বন্ধ হয়ে যায় । এইরকম একসঙ্গে পুরুষ মহিলা সকলে মিলে গানবাজনা গল্প আমোদপ্রমোদ আহারাদিতে একটা সন্ধ্যা কাটানো कव् | এখানে মিলনের উপলক্ষ কতপ্রকার আছে, তার সংখ্যা নেই। för IKI, K77, conversazione, চা-সভা, লন পাটি, এক্সকাশন, পিকনিক ইত্যাদি । থ্যাকারে বলেন, English society has this eminent advantage over all others- that is if there be any society left in the wretched distracted old European continent- that it is above all others a dinner-giving society | অবসর পেলে এক সন্ধে বন্ধুবান্ধবদের জড়ো করে আহারাদি করা ও আমোদপ্রমোদ করে কাটানো এখানকার পরিবারের অবশ্যকর্তব্যের মধ্যে । ডিনার-সভার বর্ণনা করতে বসা বাহুল্য। ডাক্তার ম—র বাড়িতে যে পাটির কথা পূর্বে উল্লেখ করেছি, তার সঙ্গে ডিনার পার্টির প্ৰভেদ কেবল দক্ষিণ হস্তের ব্যাপারে (এ স্নেচ্ছদের দেশে ভক্ষণটা আবার দক্ষিণ বাম উভয় হস্তের ব্যাপার)। আমি একবার এখানকার একটি বােট-যাত্রা ও পিকনিক পাটিতে ছিলুম। এখানকার একটি রাবিবারিক সভার সভ্যেরা এই বোট-যাত্রার উদযোগী । এই সভার সভ্য এবং সভ্যারা রবিবার পালনের বিরোধী। তাই তারা রবিবারে একত্র হয়ে নির্দোষ আমােদপ্রমোদ করেন। এই রাবিবারিক সভার সভ্য আমাদের এক বাঙালি মিত্র ম— মহাশয় আমাদের অনুগ্রহ করে টিকিট দেন। লন্ডন থেকে রেলোয়ে করে টেমসের ধারে এক গীয়ে গিয়ে পীেছলুম। গিয়ে দেখলুম টেমসে একটা প্ৰকাণ্ড নীেকো বাধা, আর প্রায় পঞ্চাশ-ষাটজন রবিবার-বিদ্রোহী মেয়েপুরুষে এক হয়েছেন । দিনটা অন্ধকার, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন, আর র্যাদের র্যাদের আসবার কথা ছিল, তারা সকলে আসেন নি। আমার নিজের এ