পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ ケミ○ চারি দিক খোলা, বড়ো গাছ খুব অল্প ; ছোটাে ছোটাে গুলোর ঝোপ ও ঘাসে পূর্ণ, চারি দিক সবুজ, বিচিত্র গাছপালা নেই বলে কেমন ধু ধু করছে, কেমন বিধবার মতে, চেহারা । উচুনিচু জমি, কঁাটাগাছের ঝোপঝাপ, জায়গাটা আমার খুব ভালো লাগে । মাঝে মাঝে এইরকম কাটা-খোচা এবড়ো-খেবড়োর মধ্যে এক-এক জায়গায় ব্ল-বেলস নামক ছোটাে ছোটাে ফুল ঘেঁষাৰ্ঘেষি ফুটে সবুজের মধ্যে স্তৃপাকার নীল রঙ ছড়িয়ে রেখেছে, কোথাও বা ঘাসের মধ্যে রাশ রাশ সাদা ডেজি ও হলদে বাটার-কাপ অজস্র সৌন্দর্যে প্রকাশিত ৷ ঝোপঝাপের মাঝে মাঝে এবং গাছের তলায় এক-একটা বেঞ্চি পাতা । এইটে সাধারণের বেড়াবার জায়গা । এখানে মানুষ এত অল্প ও জায়গা এত বেশি যে ঘেঁষাৰ্ঘেষি নেই । লন্ডনের বড়ো বড়ো বেড়াবার বাগানের মতো চার দিকেই ছাতা-হস্তক, টুপি-মস্তক, চােখধাধক ভিড়ের আনাগোনা নেই ; দূর-দূর বেঞ্চির মধ্যে নিরালা যুগলমূর্তি রোদুরে এক ছাতার ছায়ায় আসীন ; কিংবা তারা হাত ধরাধরি করে নিরিবিলি বেড়াচ্ছে। সবসুদ্ধ জড়িয়ে জায়গাটা উপভোগ্য ৷ এখনো গরমিকাল শেষ হয় নি । এখানে গরমিকালে সকাল ও সন্ধে অত্যন্ত সুন্দর। গরমির পূর্ণযৌবনের সময় রাত দুটাে-তিনটের পরে আলো দেখা দিতে আরম্ভ করে, চারটের সময় রোদুর ঝাঝা করতে থাকে ও রাত্ৰি ন-টা দশটার আগে দিনের আলো নেবে না। আমি একদিন পাচটার সময় উঠে। কমন-এ বেড়াতে গিয়েছিলুম। পাহাড়ের উপর একটা গাছের তলায় গিয়ে বসলুম, দূরে ছবির মতো ঘুমন্ত শহর, একটুও কুয়াশা নেই। নির্জন রাস্তাগুলি, গির্জের উন্নত চুড়া, রৌদ্ররঞ্জিত বাড়িগুলি নীল আকাশের পটে যেন একটি কাঠে খোদাই করা ছবির মতো আঁকা । আসলে এই শহরটা কিছুই ভালো দেখতে নয় ; এখানকার বাড়িগুলোতে জানলা-কাটা-কাটা চারটে দেয়াল, একটা ঢালু। ছাদ ও তার উপরে ধোয়া বেরোবার কতকগুলি কুশ্ৰী নল । ক্ৰমে ক্রমে যতই বেলা হতে লাগল শত শত চিমনি থেকে আমনি ধোয়া বেরোতে লাগল, ধোয়াতে ক্ৰমে শহরটা অস্পষ্ট হয়ে এল, রাস্তায় ক্ৰমে মানুষ দেখা দিল, গাড়িঘোড়া ছুটতে আরম্ভ হল, হাতগাড়ি কিংবা ঘোড়ার গাড়িতে করে দোকানিরা মাংস রুটি তরকারি বাড়ি বাড়ি বিতরণ করে বেড়াতে লাগল (এখানে দোকানিরা বাড়িতে বাড়িতে জিনিসপত্র দিয়ে আসে), ক্ৰমে কমন-এ লোক জমতে শুরু হল, আমি বাড়ি ফিরে এলেম । এখানে আমার একটি শখের বেড়াবার জায়গা আছে । গাড়ির চাকার দাগে এবড়ো-খেবড়ো উচুনিচু আশেপাশে ঘাস ও ঘাসের মধ্যে ডেজি প্রভৃতি বুনোফুল । শ্রমজীবীরা ধুলোেকাদা-মাখানো ময়লা কোট-প্যান্টলুন ও ময়লা মুখ নিয়ে আনাগোনা করছে, ছোটাে ছোটাে ছেলেমেয়ে লাল লাল ফুলো ফুলো মুখে বাড়ির দরজার বাইরে কিংবা রাস্তায় খেলা করছে— এমন মোটাসোটা গোলগাল ছেলে কোনো দেশে দেখি নি । এক-একটা বাড়ির কাছে ছোটাে ছোটাে পুকুরের মতো, সেখানে পোষা হাসগুলো ভাসছে। মাঠগুলো যদিও পাহাড়ে, উচুনিচু, কিন্তু চাষা জমি সমতল ও পরিষ্কার । ঘাসগুলো অত্যন্ত সবুজ ও তাজা, এখানে রৌদ্র তীব্র নয় বলে ঘাসের রঙ আমাদের দেশের মতন জ্বলে যায় না, তাই এখানকার মাঠের দিকে চেয়ে থাকতে অত্যন্ত ভালো লাগে, অজস্র স্নিগ্ধ সবুজ রঙে চোখ যেন ডুবে যায়। মাঝে মাঝে বড়ো বড়ো গাছ ও সাদা সাদা বাড়িগুলো দূর থেকে ছােটাে ছােটাে দেখাচ্ছে । এইরকম শূন্য মাঠ ছাড়িয়ে অনেক দূরে এসে এক-একটা প্রকাণ্ড পাইন গাছের অরণ্য পাওয়া যায়, ঘেঁষাঘেষি গাছে অনেক দূর জুড়ে অন্ধকার, খুব গভীর, খুব নিস্তব্ধ । নবম পত্র গরমি কাল। সুন্দর সূর্য উঠেছে। এখন দুপুর দুটাে বাজে। আমাদের দেশের শীতকালের দুপুরবেলাকার বাতাসের মতো বেশ একটি মিষ্টি হাওয়া। রোদুরে চার দিক ঝাঁ বঁঠা করছে। এমন ভালো লাগছে আর এমন একটু কেমন উদাস ভাব মনে আসছে যে কী বলব। আমরা এখন ডেভনশিয়রের অন্তৰ্গত টার্কি বলে এক নগরে আছি । সমুদ্রের ধারে । চারি দিকে