পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৫৮

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-প্রবাসীর পত্ৰ brSa করেন । বিলেতে লোকে কাশিকে ভয় করে ; যদি দৈবাৎ আমি দিনের মধ্যে দুবার কেশেছি তা হলেই তিনি জোর করে আমার স্নান বন্ধ করান, আমাকে দশ রকম ওষুধ গেলান, শুতে যাবার আগে আমার পায়ে খানিকটা গরম জল ঢালবার বন্দোবস্ত করেন, তবে ছাড়েন । বাড়ির মধ্যে সকলের আগে বড়ো মিস ক— ওঠেন, তিনি নীচে এসে ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়েছে কি না তদারক করেন ; অগ্নিকুণ্ডে দু-চার হাত কয়লা দিয়ে ঘরটি বেশ উজ্জ্বল করে রাখেন। খানিক বাদে সিঁড়িতে একটা দুদ্দাড় পায়ের শব্দ শুনতে পাওয়া যায় । বুড়ো ক— শীতে হি হি করতে করতে খাবার ঘরে এসে উপস্থিত । তাড়াতাড়ি আগুনে হাত-পা পিঠ-বুক তাতিয়ে খবরের কাগজ হাতে খাবার টেবিলে এসে বসেন । তার বড়ো মেয়েকে চুম্বন করেন, আমার সঙ্গে সুপ্ৰভাত অভিবাদন হয় । লোকটা প্ৰফুল্ল । আমার সঙ্গে খানিকটা হসিতামাশা হয়, খবরের কাগজ থেকে এটা-ওটা পড়ে শোনান । তার এক পেয়ালা কফি শেষ হয়ে গেছে, এমন সময়ে তার আর দুটি মেয়ে এসে তাকে চুম্বন করলেন । তাদের সঙ্গে তার বন্দোবস্ত ছিল যে, তারা যেদিন মিস্টার ক—র আগে উঠবেন, সেদিন মিস্টার ক— তাদের পঁাচ সিকে পুরস্কার দিবেন, আর যেদিন মিস্টার কি- তাদের আগে উঠবেন, সেদিন তাদের চার আনা দণ্ড দিতে হবে । যদিও এত অল্প দিতে হত, তবু তাদের কাছে প্ৰায় দু-তিন পাউন্ড পাওনা হয়েছে। রোজ সকালে পাওনাদার পাওনার দাবি করেন ; কিন্তু দেনাদাররা হেসেই উড়িয়ে দেন । ক— বলেন, “এ ভরি অন্যায় ।” আমাকে মাঝে মাঝে মধ্যস্থ মেনে বলেন, “আচ্ছা মিস্টার টি— তুমিই বলো, এরকম ডেট । অফ অনার ফাকি দেওয়া কি ভদ্রতা ?” যা হােক পরিশোধের অভাবে পাওনা বেড়েই চলেছে । তার পরে মিসেস ক- এলেন । আমাদের ব্রেকফাস্ট প্রায় সাড়ে ন-টার মধ্যে শেষ হয় । বাড়ির বড়ো ছেলে আগেই খাওয়া সেরে কাজে গিয়েছেন, আর মিস্টার ক—র ছোটো ছেলেটি ও ছোটো মেয়েটি অনেকক্ষণ হল খাওয়া শেষ করেছে। একজনের কথা বলতে ভুলে গিয়েছি। টেবি কুকুরটি অনেকক্ষণ । হল এসে আগুনের কাছে বসে আছে । ছোট্ট কুকুরটি । ঝাঁকড়া ঝাকড়া রোয়া । রোয়াতে চোখমুখ ঢাকা । বুড়ো হয়েছে, আর তার একটা চোখ কানা হয়ে গেছে । আদর পেয়ে পেয়ে এই ব্যক্তির অভ্যাস হয়েছে নবাবি চাল । ড্রয়িংরুম ছাড়া অন্য কোনো ঘরে তার মনে বসে না । ঘরের সকলের চেয়ে ভালো কেদারাটিতে অমানবদনে লাফিয়ে উঠে বসে, এক পাশে যদি আর কেউ এসে বসল, অমনি সে বরাদ্দ । সে বিস্কুটগুলি নিয়ে খাবার ঘরে বসে থাকে, যতক্ষণ আমি গিয়ে সেই বিস্কুটগুলি নিয়ে তার সঙ্গে খানিকটা খেলা করি, একবার তার মুখ থেকে কেড়ে নিই একবার গড়িয়ে দিই। আগে আগে যখন আমার উঠতে দেরি হত, সে তার বরাদ্দ বিস্কুট নিয়ে আমার শোবার ঘরের কাছে বসে ঘেউ ঘেউ করত । কিন্তু গোল করলে বিরক্ত হতুম দেখে সে এখন আর ঘেউ ঘেউ করে না । আস্তে আস্তে পা দিয়ে দরজা ঠেলে, যতক্ষণ না দরজা খুলে দিই চুপ করে বাইরে বসে থাকে। দরজা খুলে ঘর থেকে বেরোলেই লাফিয়ে ঝাপিয়ে লেজ নেড়ে উৎসাহ প্ৰকাশ করে ; তার পরে একবার বিস্কুটের দিকে চায় একবার আমার মুখের দিকে । যা হােক সাড়ে ন-টার মধ্যে ব্রেকফাস্ট শেষ হয় । তার পরে হাতে দস্তানা পরা গৃহিণী দাসীদের নিয়ে তার চেতলা থেকে একতলা পর্যন্ত, জিনিসপত্র গুছিয়ে ঘরদ্ধার পরিষ্কার ও গৃহকাৰ্য তদারক করে ওঠা-নাবায় প্রবৃত্ত । একবার রান্নাঘরে যান, সেখানে শাকওআলা। রুটিওআলা মাংসওআলার বিল দেখেন, দেনা চুকিয়ে দেন । মাঝে মাঝে উপরে এসে কর্তার সঙ্গে গৃহকার্যের পরামর্শ হয়। রান্নাঘরের উপকরণ পরিষ্কার আছে কি না ও যথাস্থানে তাদের রাখা হয়েছে কি না দেখেন, ভালো মাংস এনেছে কি না, ওজনে কম পড়েছে কি না তদন্ত করেন । রাধুনির সঙ্গে মাঝে মাঝে যোগ দেন । এইরকম ব্রেকফাস্টের পর থেকে প্রায় বেলা একটা-দেড়টা পর্যন্ত তাকে নানাবিধ কাজে ব্যস্ত থাকতে হয় । মাঝে মাঝে তার সঙ্গে তার বড়ো মেয়ে যোগ দেন । মেজো মেয়ে প্ৰত্যহ একটি ঝাড়ন নিয়ে ড্রয়িং রুম সাফ করেন । দাসীরা ঘর ঝাঁট দিয়ে যায়, আর জিনিসপত্রে যা-কিছু ধুলো লাগে তা তিনি নিজের হাতে ঝেড়ে-ঝুড়ে সাফ করেন । তৃতীয় মেয়ে বালিশের আচ্ছাদন আসন মোজা কাপড় প্রভৃতি নানাবিধ সেলাইয়ে নিযুক্ত হন, চিঠিপত্র লেখেন, এক-একদিন বাজনা ও