পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৬৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি - শুক্রবার । ২২শে আগস্ট ১৮৯০ । দেশকালের মধ্যে যে একটা প্ৰাচীন ঘনিষ্ঠতা আছে, বাষ্পযানে সেটা লোপ করে দেবার চেষ্টা করছে। পূর্বে সময় দিয়ে দূরত্বের পরিমাণ হত ; লোকে বলত এক প্ৰহরের রাস্তা, দুদিনের রাস্তা । এখন কেবল গজের মাপটাই অবশিষ্ট । দেশকালের চিরদাম্পত্যের মাঝখান দিয়ে অবাধে বড়ো বড়ো কলের গাড়ি এবং কলের জাহাজ চলে যাচ্ছে । কেবল তাই নয়— এশিয়া এবং আফ্রিকা দুই ভগ্নীর বাহুবন্ধন বিচ্ছিন্ন করে মাঝে বিরহের লবণাম্বুরাশি প্রবাহিত করা হয়েছে। আমেরিকার উত্তর দক্ষিণ যমজ ভ্রাতার মতো জন্মাবধি সংলগ্ন হয়ে আছে, শোনা যায়। তাদের মধ্যেও লৌহাস্ত্ৰ চালনার উদ্যোগ করা হয়েছিল । এমনি করে সভ্যতা সর্বত্রই জলে স্থলে দেশে কালে গাহবিচ্ছেদ ঘটিয়ে দিয়ে আপনার পথটি করে নেবার চেষ্টা করছে । পূর্বে যখন দীর্ঘ পথ প্ৰদক্ষিণ করে যুরোপে পৌঁছতে অর্ধেক বৎসর লাগত। তখন এই দুই মহাদেশের যথার্থ ব্যবধান সম্পূর্ণ ধারণা করবার দীর্ঘকাল অবসর পাওয়া যেত। এখন ক্রমেই সেটা হ্রাস হয়ে আসছে । O কিন্তু দেশকালের ঘনিষ্ঠতা যতই হ্রাস হােক, চিরকালের অভ্যাস একেবারে যাবার নয়। যদিও তিন মাসের টিকিট মাত্র নিয়ে যুরোপে চলেছি, তবু একটা কাল্পনিক দীর্ঘকালের বিভীষিকা মন থেকে তাড়াতে পারছি নে । মনে হচ্ছে যেন অনেক দিনের জন্যে চলেছি । কালিদাসের সময়ে যখন রেলগাড়ি ইস্টিমার পোস্ট-আপিস ছিল না তখনই খাটি বিরহ ছিল ; এবং তখনকার দিনে বছরখানেকের জন্য রামগিরিতে বদলি হয়ে যক্ষ যে সুদীর্ঘচ্ছন্দে বিলাপ-পরিতাপ করেছিল সে তার পক্ষে অযথা হয় নি। কিন্তু স্তুপাকার তুলো যেমন কলে চেপে একটি পরিমিত গাটে পরিণত হয়, সভ্যতার চাপে আমাদের সমস্তই তেমনি সংক্ষিপ্ত নিবিড় হয়ে আসছে। ছয় মাসকে জাতার তলায় ফেলে তিন মাসের মধ্যে ঠেসে দেওয়া হচ্ছে ; পূর্বে যা মুটের মাথার বোঝা ছিল এখন তা পকেটের মধ্যে ধরে । এখন দু-এক পাতার মধ্যেই বিরহগীতির সমাপ্তি এবং বিদ্যুৎযান যখন প্রচলিত হবে তখন বিরহ এত গাঢ় হবে যে চতুর্দশপদীও তার পক্ষে ঢ়িলে বোধ হবে । সূর্য অস্তপ্রায় । জাহাজের ছাদের উপর হালের কাছে দাড়িয়ে ভারতবর্ষের তীরের দিকে চেয়ে রইলুম । সমুদ্রের জল সবুজ, তীরের রেখা নীলাভ, আকাশ মেঘাচ্ছন্ন। সন্ধ্যা রাত্রির দিকে এবং জাহাজ সমুদ্রের মধ্যে ক্রমশই অগ্রসর হচ্ছে। বামে বোম্বাই বন্দরের দীর্ঘ রেখা এখনো দেখা যাচ্ছে। ক্ৰমে বন্দর ছড়িয়ে গেলুম। সন্ধ্যার মেঘাবৃত অন্ধকারটি সমুদ্রের অনন্ত শয্যায়৷ দেহ বিস্তার করলে। আকাশে তারা নেই। কেবল দূরে লাইট-হাউসের আলো জ্বলে উঠল ; সমুদ্রের শিয়রের কাছে সেই কম্পিত দীপশিখা যেন ভাসমান সন্তানদের জন্যে ভূমিমাতার আশঙ্কাকুল জাগ্ৰত দৃষ্টি । জাহাজ বোম্বাই বন্দর পার হয়ে গেল । ভাসল তরী সন্ধেবেলা, ভাবিলাম এ জলখেলা, মধুর বহিবে বায়ু, ভেসে যাব রঙ্গে । কিন্তু সী-সিকনেসের কথা কে মনে করেছিল ! w যখন সবুজ জল ক্রমে নীল হয়ে এল এবং তরঙ্গে তরীতে মিলে আন্দোলন উপস্থিত করে দিলে তখন দেখলুম সমুদ্রের পক্ষে জলখেলা বটে। কিন্তু আমার পক্ষে নয় । ভাবলুম এইবেলা মানে মানে কুঠুরির মধ্যে ঢুকে কম্বলটা মুড়ি দিয়ে শুয়ে পড়ি গে। যথাসত্বর ক্যাবিনের মধ্যে প্রবেশ করে কাধ থেকে কম্বলটা বিছানার উপর ফেলে দরজা বন্ধ করে দিলুম। ঘর