পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৬৭

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

し^○○ রবীন্দ্র-রচনাবলী অন্ধকার । বুঝলুম, আলো নিবিয়ে দিয়ে দাদা তার বিছানায় শুয়েছেন। শারীরিক দুঃখ নিবেদন করে একটুখানি স্নেহ উদ্রেক করবার অভিপ্ৰায়ে জিজ্ঞাসা করলুম, “দাদা, ঘুমিয়েছেন কি ?” হঠাৎ নিতান্ত বিজাতীয় মোটা গলায় কে একজন হুংকার দিয়ে উঠল, “হুজ দ্যাট !” আমি বললুম, “বাস রে ! এ তো দাদা নয় ।” তৎক্ষণাৎ বিনীত অনুতপ্ত স্বরে জ্ঞাপন করলুম, “ক্ষমা করবেন, দৈবক্রমে ভুল কুঠরিতে প্রবেশ করেছি।” অপরিচিত কণ্ঠ বললে, “অল রাইট !” কম্বলটি পুনশ্চ তুলে নিয়ে কাতর শরীরে সংকুচিত চিত্তে বেরোতে গিয়ে দেখি দরজা খুঁজে পাই নে। বাক্স তোরঙ্গ লাঠি বিছানা প্রভৃতি বিচিত্র জিনিসের মধ্যে খটু খটু শব্দে হাতড়ে বেড়াতে লাগলুম। ইদুর কলে পড়লে তার মানসিক ভাব কী রকম হয় এই অবসরে কতকটা বুঝতে পারা যেত, কিন্তু তার সঙ্গে সমুদ্রপীড়ার সংযোগ হওয়াতে ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত জটিল হয়ে পড়েছিল। মন যতই ব্যাকুল হয়ে উঠছে শরীর ততই গলদঘর্ম এবং কণ্ঠাগত অন্তরিান্দ্ৰিয়ের আক্ষেপ উত্তরোত্তর অবাধ্য হয়ে উঠছে। অনুসন্ধানের পর যখন হঠাৎ মসৃণ চিক্কণ শ্বেতকাচ-নির্মিত দ্বারকর্ণটি হাতে ঠেকল, তখন মনে হল এমন প্রিয়স্পৰ্শীসুখ বহুকাল অনুভব করা হয় নি। দরজা খুলে বেরিয়ে পড়ে নিঃসংশয়চিত্তে পরবর্তী ক্যাবিনের দ্বারে গিয়ে উপস্থিত। গিয়েই দেখি, আলো জুলছে ; কিন্তু মেঝের উপর পরিত্যক্ত গাউন পেটিকেট প্রভৃতি স্ত্রীলোকের গাত্রাবরণ বিক্ষিপ্ত । আর অধিক কিছু দৃষ্টিপথে পড়বার পূর্বেই পলায়ন করলুম। প্রচলিত প্ৰবাদ অনুসারে বার বার তিন বার ভ্রম করবার অধিকার সকলেরই আছে, কিন্তু তৃতীয় বার পরীক্ষা করতে সাহস হল না । এবং সেরূপ শক্তিও ছিল না । অবিলম্বে জাহাজের ছাতে গিয়ে উপস্থিত হলুম। সেখানে বিহবলচিত্তে জাহাজের কােঠরার পরে ঝুকে পড়ে শরীরমনের একান্ত উদবেগ কিঞ্চিৎ লাঘব করা গেল। তার পরে বহুলাঞ্ছিত অপরাধীর মতো আস্তে আস্তে কম্বলটি গুটিয়ে তার উপর লজিত নতমস্তক স্থাপন করে একটি কাঠের বেঞ্চিতে শুয়ে পড়লুম। 4 কী সর্বনাশ ! এ কার কম্বল ! এ তো আমার নয় দেখছি। যে সুখসুপ্ত বিশ্বস্ত ভদ্রলোকটির ঘরের মধ্যে রাত্রে প্রবেশ করে কয়েক মিনিট ধরে অনুসন্ধান-কার্যে ব্যাপৃত ছিলুম নিশ্চয় এ তারই । একবার ভাবলুম ফিরে গিয়ে চুপিচুপি তার কম্বল স্বস্থানে রেখে আমারটি নিয়ে আসি ; কিন্তু যদি তার ঘুম ভেঙে যায় ! পুনর্বার যদি তার ক্ষমা প্রার্থনা করবার প্রয়োজন হয় তবে সে কি আর আমাকে বিশ্বাস করবে ! যদি বা করে, তবু এক রাত্রের মধ্যে দুবার ক্ষমা প্রার্থনা করলে নিদ্রাকাতর বিদেশীর খৃস্টীয় সহিষ্ণুতার প্রতি অতিমাত্র উপদ্রব করা হবে না কি ! আরো একটা ভয়ংকর সম্ভাবনার কথা মনে উদয় হল । দৈববশত দ্বিতীয়বার যে ক্যাবিনের দ্বারে গিয়ে পড়েছিলুম তৃতীয়বারও যদি ভ্ৰমক্ৰমে সেইখানে গিয়েই উপস্থিত হই এবং প্রথম ক্যাবিনের ভদ্রলোকটির কম্বলটি সেখানে রেখে সেখানকার একটি গাত্ৰাচ্ছাদন তুলে নিয়ে আসি তা হলে কী রকমের একটা রোমহর্ষণ প্ৰমাদ-প্ৰহেলিকা উপস্থিত হয় ! ইত্যাকার দুশ্চিন্তায় তীব্ৰ তাম্রকূটবাসিত পরের কম্বলের উপর. কাষ্ঠাসনে রাত্রি যাপন করলুম। ২৩ আগস্ট । আমার স্বদেশীয় সঙ্গী বন্ধুটি সমস্ত রাত্রির সুখনিদ্রাবসানে প্ৰাতঃকালে অত্যন্ত প্ৰফুল্ল পরিপুষ্ট সুস্থ মুখে ডেকের উপর দর্শন দিলেন । আমি তার দুই হস্ত চেপে ধরে বললুম, “ভাই, আমার তো এই অবস্থা ।” শুনে তিনি আমার বুদ্ধিবৃত্তির উপর কলঙ্ক আরোপ করে হাস্যসহকারে এমন দুটাে-একটা বিশেষণ প্রয়োগ করলেন যা গুরুমহাশয়ের সান্নিধ্য পরিত্যাগের পর থেকে আর কখনো শোনা হয় নি । সমস্ত রজনীর দুঃখের পর প্রভাতের এই অপমানটাও নিরুত্তরে সহ্য করলুম। অবশেষে তিনি দয়াপরবশ হয়ে আমার ক্যাবিনের ভৃত্যটিকে ডেকে দিলেন । তাকেও আবার একে একে সমস্ত ঘটনাটি খুলে বলতে হল । প্রথমে সে কিছুই বুঝতে পারলে না, মুখের দিকে তাকিয়ে রইল। তার জীবনের অভিজ্ঞতায় নিঃসন্দেহ এরকম ঘটনা এই প্রথম । অবশেষে ধীরে ধীরে সে সমুদ্রের দিকে একবার মুখ ফেরালে এবং ঈষৎ হাসলে ; তার পর চলে গেল। সী-সিকনেস ক্রমশ বৃদ্ধি পেতে লাগল। সে-ব্যাধিটার যন্ত্রণা অনভিজ্ঞ স্থলচরদের কিছুতে বোঝানো যেতে পারে না । নাড়িতে ভারতবর্ষের অন্ন তিলমাত্র অবশিষ্ট রইল না। য়ুরোপে প্রবেশ করবার পূর্বে