পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

যুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি br8 ○ আবার হঠাৎ ডান দিকে আমাদের সেই পূর্বসঙ্গিনী মুহুর্তের জন্যে দেখা দিয়ে বামে চলে গেল । একবার দক্ষিণে, একবার বামে, একবার অন্তরালে । আবার হয়তো যেতে যেতে কোনো এক পর্বতের আড়াল থেকে সহসা কলহাস্যে করতালি দিয়ে আচমকা দেখা দেবে । সেই জলপাই এবং দ্রাক্ষাকুঞ্জ অনেক কমে গেছে ; বিবিধ শস্যের ক্ষেত্র এবং দীর্ঘ সরল পপলার গাছের শ্রেণী | ভুট্টা, তামাক, নানাবিধ শাকসবজি। কেবলই যেন বাগানের পর বাগান । এই কঠিন পর্বতের মধ্যে মানুষ বহুদিন থেকে বহু যত্নে প্রকৃতিকে বশ করে তার উচ্ছঙ্খলতা হরণ করেছে। প্রত্যেক ভূমিখণ্ডের উপর মানুষের কত প্ৰয়াস প্রকাশ পাচ্ছে। এ দেশের লোকেরা যে আপনার দেশকে ভালোবাসবে তাতে কিছু আশ্চর্য নেই। এরা আপনার দেশকে আপনার "ত্নে আপনার করে নিয়েছে। এখানে প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের বহুকাল থেকে একটা বোঝাপড়া হয়ে আসছে, উভয়ের মধ্যে ক্রমিক আদানপ্রদান চলছে, তারা পরস্পর সুপরিচিত এবং ঘনিষ্ঠ সম্পর্কে আবদ্ধ। এক দিকে প্রকাণ্ড প্রকৃতি উদাসীনভাবে দাড়িয়ে, আর-এক দিকে বৈরাগ্যবৃদ্ধ মানব উদাসীনভাবে শুয়ে- য়ুরোপের সে-ভাব নয় । এদের এই সুন্দরী ভূমি এদের একান্ত সাধনার ধন, একে এরা নিয়ত বহু আদর করে রেখেছে । এর জন্যে যদি প্ৰাণ না দেবে তো কিসের জন্যে দেবে ! এই প্ৰেয়সীর প্রতি কেউ তিলমাত্র হস্তক্ষেপ করলে কি আর সহ্য হয় ? আমরা তো জঙ্গলে থাকি ; খালবিল বনবাদােড় ভাঙারাস্তা এবং পানাপুকুরের ধারে বাস করি । খেত থেকে দু-মুঠো ধান আনি, মেয়েরা আঁচল ভরে শাক তুলে নিয়ে আসে, ছেলেরা পাকের মধ্যে নেমে চিংড়িমাছ ধরে আনে, প্রাঙ্গণের গাছ থেকে গোটাকতক তেঁতুল পাড়ি, তার পরে শুকনো কাঠকুট সংগ্রহ করে এক-বেলা অথবা দু-বেলা কোনোরকম করে আহার চলে যায় ; ম্যালেরিয়া এসে যখন জীর্ণ অস্থিকঙ্কাল কঁাপিয়ে তোলে তখন কঁথা মুড়ি দিয়ে রৌদ্রে পড়ে থাকি, গ্ৰীষ্মকালে শুষ্কপ্রায় পঙ্ককুণ্ডের হরিদাবর্ণ জলাবশেষ থেকে উঠে এসে ওলাউঠা যখন আমাদের গৃহ আক্রমণ করে তখন ওলাদেবীর পূজা দিই এবং অদৃষ্টের দিকে কোটরপ্রবিষ্ট হতাশ শূন্যদৃষ্টি বদ্ধ করে দল বেঁধে মরতে আরম্ভ করি । আমরা কি আমাদের দেশকে পেয়েছি না পেতে চেষ্টা করেছি ? আমরা ইহলোকের প্রতি ঔদাস্য করে এখানে কেবল অনিচ্ছক পথিকের মতো যেখানে-সেখানে পড়ে । থাকি এবং যত শীঘ্ৰ পারি দ্রুতবেগে বিশ-পঁচিশটা বৎসর ডিঙিয়ে একেবারে পরলোকে গিয়ে উপস্থিত হই । কিন্তু এ কী চমৎকার চিত্ৰ ! পর্বতের কোলে, নদীর ধারে, হ্রদের তীরে পপলার-উইলো-বেষ্টিত কাননশ্রেণী । নিষ্কণ্টক নিরাপদ নিরাময় ফলশস্যপরিপূর্ণ প্রকৃতি প্রতিক্ষণে মানুষের ভালোবাসা পাচ্ছে এবং মানুষকে দ্বিগুণ ভালোবাসছে। মানুষের মতো জীবের এই তো যোগ্য আবাসস্থান । মানুষের প্রেম এবং মানুষের ক্ষমতা যদি আপনার চতুর্দিককে সংযত সুন্দর সমুজ্জ্বল করে না তুলতে পারে তবে তরুকোটর-গুহাগহবর-বনবাসী জন্তুর সঙ্গে মানুষের প্রভেদ কী ? ৮ সেপ্টেম্বর । পথের মধ্যে আমাদের প্যারিসে নাববার প্রস্তাব হচ্ছে । কিন্তু আমাদের এই ট্রেন প্যারিসে যায় না— একটু পাশ কাটিয়ে যায়। প্যারিসের একটি নিকটবতী স্টেশনে স্পেশাল ট্রেন প্ৰস্তুত রাখবার জন্যে টেলিগ্ৰাফ করা গেল । রাত দুটাের সময় আমাদের জাগিয়ে দিলে। ট্রেন বদল করতে হবে। জিনিসপত্র বেঁধে বেরিয়ে পড়লুম। বিষম ঠাণ্ডা। অনতিদূরে আমাদের গাড়ি দাঁড়িয়ে । কেবলমাত্র একটি এঞ্জিন, একটি ফাস্টক্লাস এবং একটি ব্রেকভ্যান । আরোহীর মধ্যে আমরা তিনটি ভারতবর্ষীয় । রাত তিনটের সময় প্যারিসের জনশূন্য বৃহৎ স্টেশনে পৌঁছনাে গেল। সুপ্তোখিত দুই-একজন “মসিয়” আলো-হস্তে উপস্থিত। অনেক হাঙ্গাম করে নিদ্রিত কাস্টম-হাউসকে জাগিয়ে তার পরীক্ষা থেকে উত্তীর্ণ হয়ে একটা গাড়ি ভাড়া করলুম। তখন প্যারিস তার সমস্ত দ্বার রুদ্ধ করে স্তব্ধ রাজপথে দীপশ্রেণী জ্বালিয়ে রেখে নিদ্রামগ্ন । আমরা হােটেল ট্যামিনুতে আমাদের শয়নকক্ষে প্রবেশ করলুম। পরিপাটি, পরিচ্ছন্ন, বিদ্যুদুজ্জ্বল, স্ফটিকমণ্ডিত, কাপেটাবৃত, চিত্রিতাভিত্তি, নীলাযবনিকাপ্ৰচ্ছন্ন শয়নশালা ; বিহগপক্ষ সুকোমল শুভ্ৰ শয্যা ।