পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭৬

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

য়ুরোপ-যাত্রীর ডায়ারি Եr8 (շ সেখান থেকে বেরিয়ে, লন্ডনের সুরঙ্গপথে যে পাতাল-বাষ্পযান চলে, তাই অবলম্বন করে বাসায় ফেরবার চেষ্টা করে গেল। কিন্তু পরিণামে দেখতে পেলুম পৃথিবীতে সকল চেষ্টা সহজে সফল হয় না। আমরা দুই ভাই তো গাড়িতে চড়ে বেশ নিশ্চিন্ত বসে আছি ; এমন সময় গাড়ি যখন হ্যামারস্মিথ নামক দূরবতী স্টেশনে গিয়ে থামল তখন আমাদের বিশ্বাসপরায়ণ চিত্তে ঈষৎ সংশয়ের সঞ্চার হল । একজনকে জিজ্ঞাসা করাতে সে স্পষ্ট বুঝিয়ে দিলে আমাদের গম্যস্থান যে দিকে এ-গাড়ির গম্যস্থান সে দিকে নয় । পুনর্বাের তিন-চার স্টেশন ফিরে গিয়ে গাড়ি বদল করা আবশ্যক। তাই করা গেল । অবশেষে গম্য স্টেশনে নেমে রাস্তায় বেরিয়ে আমাদের বাসা খুঁজে পাই নে । বিস্তর গবেষণার পর বেলা সাড়ে তিনটের সময় বাড়ি ফিরে ঠাণ্ডা টিফিন খাওয়া গেল। এইটুকু আত্মজ্ঞান জন্মেছে যে, আমরা দুটি ভাই লিভিংস্টোন অথবা স্টানলির মতো ভৌগোলিক আবিষ্কার-কার্যের যোগ্য নই। পৃথিবীতে যদি অক্ষয় খ্যাতি উপার্জন করতে চাই তো নিশ্চয়ই অন্য কোনো দিকে মনোনিবেশ করতে হবে । ১২ সেপ্টেম্বর । আমাদের বন্ধুর একটি গুণ আছে ; তিনি যতই কল্পনার চর্চা করুন-না কেন, কখনো পথ ভোলেন না । সুতরাং তাকেই আমাদের লন্ডনের পাণ্ডাপদে বরণ করেছি। আমরা যেখানে যাই তাকে সঙ্গে টেনে নিয়ে যাই এবং তিনি যেখানে যান আমরা কিছুতেই তার সঙ্গ ছাড়ি নে । কিন্তু একটা আশঙ্কা আছে, এরকম অবিচ্ছেদ্য বন্ধুত্ব এ-পৃথিবীতে সকল সময় সমাদৃত হয় না । হায় ! এ-সংসারে কুসুমে কণ্টক, কলানাথে কলঙ্ক এবং বন্ধুত্বে বিচ্ছেদ আছে— কিন্তু ভাগ্যিস আছে! ১৫ সেপ্টেম্বর | স্যাভয় থিয়েটারে “গন্ডোলিয়ার্স” নামক একটি গীতিনাট্য অভিনয় দেখতে গিয়েছিলুম। আলোকে সংগীতে সৌন্দর্যে বর্ণবিন্যাসে দৃশ্যে নৃত্যে হাস্যে কৌতুকে মনে হল একটা কোন কল্পনারাজ্যে আছি । মাঝে এক অংশে অনেকগুলি নর্তক-নর্তকীতে মিলে নৃত্য আছে ; আমার মনে হল যেন হঠাৎ এক সময়ে একটা উন্মাদকর যৌবনের বাতাসে পৃথিবী জুড়ে নরনারীর একটা উলট-পালট ঢেউ উঠেছে— তাতে আলোক এবং বর্ণচ্ছটা, সংগীত এবং উৎফুল্ল নয়নের উজ্জ্বল হাসি সহস্র ভঙ্গিতে চারি দিকে ঠিকরে পড়ছে । ] ১৬ সেপ্টেম্বর । আজ আমাদের গৃহস্বামীর কুমারী কন্যা আমার কতকগুলি পুরাতন পূর্বশ্ৰাত সুর পিয়ানোয় বাজাচ্ছিলেন ; তাই শুনে আমার গৃহ মনে পড়তে লাগল। সেই ভারতবর্ষে রৌদ্রালোকিত প্ৰাতঃকাল, মুক্ত বাতায়ন, অব্যাহত আকাশ এবং পিয়ানো যন্ত্রে এই স্বপ্নবহ পরিচিত সংগীতধ্বনি । ১৭ সেপ্টেম্বর । যে দুৰ্ভাগার শীতকোর্তা আমরা বহন করে বেড়াচ্ছি। ইন্ডিয়া আপিস যোগে সে আমাদের একটি পত্র লিখেছে- আমরাই যে তার গাত্রবস্ত্রটি সংগ্রহ করে এনেছি সে-বিষয়ে পত্ৰলেখক নিজের দৃঢ়বিশ্বাস প্রকাশ করেছে ; তার সঙ্গে ‘ভ্ৰমক্রমে বলে একটা শব্দ যোগ করে দিয়েছিল। একটা সন্তোষের বিষয় এই, যার কম্বল নিয়েছিলুম। এটা তার নয়। ভ্রমক্রমে দুবার একজনের গরম কাপড় নিলে ভ্ৰম সপ্রমাণ করা কিছু কঠিন হত । ১৯ সেপ্টেম্বর । এখানে রাস্তায় বেরিয়ে সুখ আছে। সুন্দর মুখ চোখে পড়বেই। শ্ৰীযুক্ত দেশানুরাগ যদি পারেন তো আমাকে ক্ষমা করবেন । নবনীর মতো সুকোমল শুভ্র রঙের উপরে একখানি পাতলা টুকটুকে ঠোঁট, সুগঠিত নাসিকা এবং দীর্ঘপল্লববিশিষ্ট নির্মল নীলনেত্ৰ— দেখে প্রবাসদুঃখ দূর হয়ে যায়। শুভানুধ্যায়ীরা শঙ্কিত এবং চিন্তিত হবেন, প্রিয় বয়স্যেরা পরিহাস করবেন। কিন্তু এ কথা আমাকে । স্বীকার করতেই হবে সুন্দর মুখ আমার সুন্দর লাগে । সুন্দর হওয়া এবং মিষ্ট করে হাসা মানুষের যেন একটি পরমাশ্চর্য ক্ষমতা । কিন্তু দুঃখের বিষয় আমার ভাগ্যক্রমে ঐ হাসিটা এ দেশে কিছু বাহুল্য পরিমাণে পেয়ে থাকি । অনেক সময়ে রাজপথে কোনো নীলনয়না পান্থরমণীর সম্মুখবর্তী হবামাত্র সে আমার মুখের দিকে চেয়ে আর হাসি সংবরণ করতে পারে না। তখন তাকে ডেকে বলে দিতে ইচ্ছা! করে, “সুন্দরী, আমি হাসি ভালোবাসি বটে, কিন্তু এতটা নয়। তা ছাড়া বিম্বাধরসংলগ্ন হাসি যতই সুমিষ্ট হােক-না কেন, তারও একটা যুক্তিসংগত কারণ থাকা চাই ; কারণ, মানুষ কেবলমাত্র যে সুন্দর তা নয়, মানুষ বুদ্ধিমান জীব। হে নীলাজনয়নে, আমি তো ইংরেজের মতো অসভ্য খাটাে কুর্তি এবং