পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৭৯

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

br8 by রবীন্দ্ৰ-রচনাবলী আয়োজন হয় নি ।” বক বোধ করি মাথা নেড়ে উত্তর দিয়েছিল, “আহা, সে কী কথা । রন্ধন অতি পরিপাটি হয়েছে। কিন্তু শরীরগতিকে আজ আমার ক্ষুধা বোধ হচ্ছে না।” পরদিন বকের নিমন্ত্রণে শৃগাল গিয়ে দেখেন, লম্বা ভীড়ের মধ্যে বিবিধ উপাদেয় সামগ্ৰী সাজানো রয়েছে। দেখে লোভ হয় কিন্তু তার মধ্যে শৃগালের মুখ প্রবেশ করে না । বক অনতিবিলম্বে লম্বচঞ্চ চালনা করে ভোজনে প্ৰবৃত্ত হল। শৃগাল বাহিরের থেকে পাত্ৰলেহন এবং দুটাে-একটা উৎক্ষিপ্ত খাদ্যখণ্ডের স্বাদগ্ৰহণ করে নিতান্ত ক্ষুধাতুরভাবে বাড়ি ফিরে গেল । জাতীয় ভোজে বিদেশীর অবস্থা সেইরকম । খাদ্যটা উভয়ের পক্ষে সমান উপাদেয়। কিন্তু পাত্রটা তফাত । ইংরেজ যদি শৃগাল হয় তবে তার সুবিস্তৃত শুভ্র রজতথালের উপর উদঘাটিত পায়সান্ন কেবল চক্ষে দর্শন করেই আমাদের ক্ষুধিতভাবে চলে আসতে হয়, আর আমরা যদি তপস্বী বক হই, তবে আমাদের সুগভীর পাথরের পাত্রটার মধ্যে কী আছে। শৃগাল তা ভালো করে চক্ষেও দেখতে পায় না— দূর থেকে ঈষৎ ঘাণ নিয়েই তাকে ফিরতে হয় । প্ৰত্যেক জাতির অতীত ইতিহাস এবং বাহ্যিক আচার-ব্যবহারে তার নিজের পক্ষে সুবিধা, কিন্তু অন্য জাতির পক্ষে বাধা । এইজন্য ইংরেজসমাজ যদিও বাহাত সাধারণসমক্ষে উদঘাটিত কিন্তু আমরা চক্ষুর অগ্রভাগটুকুতে তার দুই-চার ফোটার স্বাদ পাই মাত্র, ক্ষুধা নিবৃত্তি করতে পারি নে। সর্বজাতীয় ভোজ কেবল সাহিত্যক্ষেত্রেই সম্ভব । সেখানে যার লম্বা চঞ্চ সেও বঞ্চিত হয় না, যার লোলজিহবা সেও পরিতৃপ্ত হয় । কারণটা সাধারণের হৃদয়গ্রাহী হােক বা না হােক এখানকার লোকের সঙ্গে হীে-ডু-যু-ডু বলে, হী করে রাস্তায় ঘাটে পর্যটন করে, থিয়েটার দেখে, দোকান ঘুরে কলকারখানার তথ্য নির্ণয় করে— এমন-কি, সুন্দর মুখ দেখে আমার শ্ৰান্তি বোধ হয়েছে। অতএব স্থির করেছি এখন বাড়ি ফিরব । ৭ অক্টোবর ৷ ‘টেমস জাহাজে একটা ক্যাবিন স্থির করে আসা গেল। পরশু জাহাজ ছাড়বে। ৯ অক্টোবর । জাহাজে ওঠা গেল । এবারে আমি একা । আমার সঙ্গীরা বিলেতে রয়ে গেলেন । আমার নির্দিষ্ট ক্যাবিনে গিয়ে দেখি সেখানে এক কক্ষে চারজনের থাকবার স্থান ; এবং আর-একজনের জিনিসপত্র একটি কোণে রাশীকৃত হয়ে আছে। বাক্স-তোরঙের উপর নামের সংলগ্নে লেখা আছে ‘বেঙ্গল সিভিল সার্ভিস’ । বলা বাহুল্য, এই লিখন দেখে ভাবী সঙ্গসুখের কল্পনায় আমার মনে অপরিমেয় আনন্দের সঞ্চার হয় নি। ভাবলুম ভারতবর্ষের রোদে ঝলসা শুকনো খটখাটে হাড়-পাকা অত্যন্ত বঁাজালো বুনো অ্যাংলো-ইন্ডিয়ানের সঙ্গে আমাকে এক জাহাজে পুরেছে। গালে হাত দিয়ে বসে ভাবছি। এমন সময়ে একজন অল্পবয়স্ক সুশ্ৰী ইংরেজ যুবক ঘরের মধ্যে ঢুকে আমাকে সহাস্যমুখে শুভপ্ৰভাত অভিবাদন করলেন— মুহুর্তের মধ্যে আমার সমস্ত আশঙ্কা দূর হয়ে গেল। সবে পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ইনি ভারতবর্ষে যাত্রা করছেন। এর শরীরে ইংলন্ডবাসী ইংরেজের স্বাভাবিক সহৃদয় ভদ্রতার ভাব এখনো সম্পূর্ণ অক্ষুন্ন রয়েছে। ১০ অক্টোবর । সুন্দর প্রাতঃকাল । সমুদ্র স্থির । আকাশ পরিষ্কার । সূর্য উঠেছে। ভোরের বেলা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে আমাদের ডান দিক থেকে অল্প অল্প তীরের চিহ্ন দেখা যাচ্ছে। অল্পে অল্পে কুয়াশার যবনিকা উঠে গিয়ে ওয়াইট দ্বীপের পার্বত্য তীর এবং ভেন্টনর শহর ক্রমে ক্রমে প্রকাশিত হয়ে পড়ল । এ জাহাজে বড়ো ভিড় । নিরিবিলি কোণে চৌকি টেনে যে একটু লিখব তার জো নেই, সুতরাং সম্মুখে যা-কিছু চােখে পড়ে তাই চেয়ে চেয়ে দেখি । ইংরেজ মেয়ের চোখ নিয়ে আমাদের দেশের লোক প্রায়ই ঠাট্টা করে, বিড়ালের চোখের সঙ্গে তার তুলনা করে থাকে। কিন্তু এমন সর্বদাই দেখা যায়, তারাই যখন আবার বিলেতে আসে তখন স্বদেশের হরিণনিয়নের কথাটা আর বড়ো মনে করে না। যতক্ষণ দূরে আছি কোনো বালাই নেই, কিন্তু লক্ষপথে প্ৰবেশ করলেই ইংরেজ সুন্দরীর দৃষ্টি আমাদের অভ্যাসের আবরণ বিদ্ধ করে অন্তরের মধ্যে প্রবেশ