পাতা:রবীন্দ্র-রচনাবলী (প্রথম খণ্ড) - সুলভ বিশ্বভারতী.pdf/৮৯৪

উইকিসংকলন থেকে
এই পাতাটির মুদ্রণ সংশোধন করা প্রয়োজন।

চিঠিপত্র চিরঞ্জীবেযু ভায়া নবীনকিশোর, এখানকার আদব-কায়দা আমার ভালো জানা নাই- সেইজন্য তোমাদের সঙ্গে প্রথম আলাপ বা চিঠিপত্র আরম্ভ করিতে কেমন ভয় করে। আমরা প্রথম আলাপে বাপের নাম জিজ্ঞাসা করিতাম, কিন্তু শুনিয়াছি এখনকার কালে বাপের নাম জিজ্ঞাসা দস্তুর নয় । সৌভাগ্যক্রমে তোমার বাবার নাম আমার অবিদিত নাই, কারণ আমিই তাহার নামকরণ করিয়াছিলাম । ভালো নাম দিতে পারি নাই— গোবর্ধন নামটা কেন দিয়াছিলাম তাহা আজ বুঝিতেছি । তোমাকে বর্ধন করিবার ভার তাহার উপরে পড়িবে ভাগ্যদেবতা তাহা জানিতেন । সেইজন্যই বোধ করি সেদিন ন্যায়রত্ন মহাশয় তোমাকে তোমার ঠাকুরের নাম জিজ্ঞাসা করাতে তোমার মুখ লাল হইয়া উঠিয়াছিল। তা, তুমিই নাহয় তোমার বাবার নূতন নামকরণ করো । আমার গোবর্ধন নাম আমি ফিরাইয়া লইতেছি। আসল কথা কী জান ? সেকালে আমরা নাম লইয়া এত ভাবিতাম না । সেটা হয়তো আমাদের তোলে। মন্দ কাজ করিলেই মানুষের বদনাম হয়, ভালো কাজ করিলেই মানুষের সুনাম হয়। বাবা কেবল একটা নামই দিতে পারে, কিন্তু ভালো নাম কিম্বা মন্দ নাম সে ছেলে নিজেই দেয় । ভাবিয়া দেখো, আমাদের প্রাচীন কালের বড়ো বড়ো নাম শুনিতে নিতান্ত মধুর নয়- যুধিষ্ঠির, রামচন্দ্ৰ, ভীষ্ম, দ্ৰোণ, ভরদ্বাজ, শাণ্ডিল্য, জন্মেজয়, বৈশম্পায়ন ইত্যাদি । কিন্তু ঐ-সকল নাম অক্ষয়বটের মতো আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষের হৃদয়ে সহস্র শিকড়ে বিরাজ করিতেছে । আমাদের আজকালকার উপন্যাসে ললিত, নলিনমোহন প্রভৃতি কত মিঠি মিঠি নাম বাহির হইতেছে, কিন্তু এখনকার পাঠক-পিপীলিকারা এই মিষ্টি নামগুলিকে দুই দণ্ডেই নিঃশেষ করিয়া ফেলে- সকালের নাম বিকালে টিকে না । যাহাই হউক, আমরা নামের প্রতি মনোযোগ করিতাম না । তুমি বলিতেছ। সেটা আমাদের ভ্ৰম । সেজন্য বেশি ভাবিয়ো না ভাই- আমরা শীঘ্রই মরিব এমন সম্ভাবনা আছে, আমাদের সঙ্গে সঙ্গে বঙ্গসমাজের সমস্ত ভ্ৰম সমূলে সংশোধিত হইয়া যাইবে । পূর্বেই বলিয়াছি এখনকার আদব-কায়দা আমার বড়ো জানা নাই ; কিন্তু ইহাই দেখিতেছি। আদব-কায়দা এখনকার দিনে নাই, আমাদের কালেই ছিল । এখন ব্যাপকে প্ৰণাম করিতে লজাবোধ হয়, বন্ধুৰান্ধবকে কোলাকুলি করিতে সংকোচ বোধ হয়, গুরুজনের সম্মুখে তাকিয়া ঠেসান দিয়া তাস পিটিতে লজাবোধ হয় না, রেলগাড়িতে যে বেঞ্চে পাঁচজনে বসিয়া আছে তাহার উপর দুইখানা পা তুলিয়া দিতে সংকোচ জন্মে না। তবে হয়তো আজকাল অত্যন্ত সহৃদয়তার প্রাদুর্ভাব হইয়াছে, আদব-কায়দার তেমন আবশ্যক নাই। সহৃদয়তা ! তাই বুঝি কেহ পাড়াপ্রতিবেশীর খোজ রাখে না ; বিপদ-আপদে লোকের সাহায্য করে না ; হাতে টাকা থাকিলে সামান্য র্জাকজমক লইয়াই থাকে, দশজন অনাথকে প্রতিপালন করে না ; তাই বুঝি পিতামাতা অযত্নে অনাদরে কষ্টে থাকেন, অথচ নিজের ঘরে সুখস্বচ্ছন্দতার অভাব নাই- নিজের সামান্য অভাবটুকু হইলেই রক্ষা নাই- কিন্তু পরিবারস্থ আর-সকলের ঘরে গুরুতর অনটন হইলেও বলেন “হাতে টাকা নাই' । এই তো, ভাই, এখনকার সহৃদয়তা । মনের দুঃখে অনেক কথা বলিলাম ! আমি কলেজে পড়ি নাই, সুতরাং আমার এত কথা বলিবার কোনো অধিকার নাই। কিন্তু তোমরা কিছু আমাদের নিন্দা করিতে ছাড় না, আমরাও যখন তোমাদের সম্বন্ধে দুই-একটা কথা বলি সে কথাগুলোয় একটু কৰ্ণপাত করিয়ো ।